“টাকার অভাবে ভালো স্কুলে কিংবা প্রাইভেট টিউশনে পড়ার সুযোগ পাইনি। গাইড বই কেনার সামর্থ্যও ছিল না। স্কুলে পড়াকালীন সময় থেকেই আমাকে লেখাপড়ার পাশপাশি নানান ধরনের দিনমজুরের কাজ করতে হয়েছে…”
বলছিলেন আতিফ আসাদ। বাংলাদের জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ি উপজেলার হাসড়া মাজালিয়া গ্রামের এই তরুণই এবার সামিল হয়েছেন সমাজের বুকে শিক্ষার আলো ফোটানোর লড়াইয়ে। প্রথম বর্ষের ছাত্র আতিফ। তবে সীমিত ক্ষমতা সত্ত্বেও একক উদ্যোগেই বাংলাদেশের বুকে গড়ে তুলেছেন একাধিক লাইব্রেরি। লক্ষ্য, সরিষাবাড়ি উপজেলার প্রতিটি গ্রামেই বিনামূল্যে পাঠাগার পরিষেবা চালু করা।
একদম কিশোর বয়স থেকেই দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই শুরু হয়েছিল আতিফের। আর স্পষ্টতই তার প্রভাব পড়েছিল পড়াশোনায়। না, প্রথাগত সুযোগ-সুবিধা কোনোটাই পায়নি আতিফ। বাবার আয়ই ছিল পরিবারের একমাত্র উপার্জনের পথ। সেখানে ৯ জনের পেট চালানোর পর, পড়াশোনার খরচ টানা খানিকটা বাতুলতাই বটে। স্বাভাবিকভাবেই তাই অল্প বয়স থেকেই আতিফকে সামিল হতে হয়েছিল ‘কর্মজীবনে’। প্রাইমারি স্কুলে পড়াকালীন সময় থেকেই মাকে নকশিকাঁথার সেলাইয়ে সাহায্য করতেন আতিফ। ধীরে ধীরে রাজমিস্ত্রি, কৃষিমজুর, রড মিস্ত্রির কাজে হাত পাকাতে হয়েছে তাঁকে। আর পড়াশোনা?
আরও পড়ুন
আগুনে ভষ্মীভূত লাইব্রেরিকে আবার গড়ে তুললেন ‘নিরক্ষর’ সৈয়দ
না, সেটা থেমে ছিল না কোনোদিনই। বই ধার করেই চলত পড়াশোনা। আর সেই কারণেই হয়তো কৈশোরেই বইয়ের গুরুত্ব বুঝেছিলেন আতিফ। তাঁর কথায়, “এই কষ্টগুলোই ছোটো থেকে বিবেককে নাড়া দিত। গ্রামাঞ্চলে কোনো পাঠাগারের ব্যবস্থা ছিল না আমাদের। কিন্তু সমাজে শিক্ষার আলো আনাটা তো দরকার। সেখান থেকেই পাঠাগার তৈরির কথা মাথায় আসে।”
আরও পড়ুন
কখনও উটের পিঠে, কখনও যুদ্ধযানে— পৃথিবীর আশ্চর্য কিছু ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির গল্প
সেটা ২০১৮ সাল। তখন একাদশ শ্রেণির ছাত্র আতিফ। লাইব্রেরি তৈরির জন্য দোকান বা কোনো আলাদা ঘর ভাড়া নেওয়ার সামর্থ্য ছিল না আতিফের। বাড়িতেই পাটের সোলা দিয়ে ছোট্ট লাইব্রেরি গড়ে তোলেন তিনি। পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর দাদা মিলন। সংগ্রহ বলতে ছিল মাত্র ২০টি বই।
আরও পড়ুন
৪১ বছর ধরে বাড়ি বাড়ি বই পৌঁছে দিয়েছেন কেরালার ‘জীবন্ত লাইব্রেরি’
কিন্তু পাঠাগার চালু হওয়ার মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই ঘটে যায় এক বিপর্যয়। পাঠাগার সংক্রান্ত জমির জন্য পারিবারিক দ্বন্দ্বের জেরে প্রাণ দিতে হয় আতিফের দাদাকে। তবে লড়াই ছাড়েননি আতিফ, “দাদাই আমার স্বপ্নদ্রষ্টা ছিল। সব সময় অনুপ্রেরণা দিত আমাকে। ওর স্মৃতিতেই এই পাঠাগারের নাম দিই ‘মিলন স্মৃতি পাঠাগার’।”
না, এই লড়াই সহজ ছিল না একেবারেই। পাড়ার লোকজন, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের থেকে গ্রন্থ সংগ্রহ করেই আতিফ ক্রমশ বাড়িয়ে তোলেন স্বপ্নের পাঠাগারের সংগ্রহ। তাছাড়াও বাড়ি বাড়ি সাইকেলে করে বই সরবরাহের দায়িত্বও তুলে নেন নিজের কাঁধে। আতিফের এই উদ্যোগে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন গ্যাসটন ব্যাটারিজ লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক এবং বাংলাদেশের এক রাষ্ট্রদূত।
শুধু নিজের বাড়িতেই নয়, বিগত কয়েক মাসে গোটা উপজেলায় ৬টি লাইব্রেরি উদ্বোধন করেছেন আতিফ। তাছাড়াও চলছে আরও বেশ কিছু লাইব্রেরি স্থাপনের কাজ। সেইসঙ্গে প্রতিটি রেলস্টেশনেও যাত্রীদের জন্য পথ লাইব্রেরি করার পরিকল্পনা রয়েছে আতিফের। ইতিমধ্যেই সরিষাবাড়ি উপজেলার তিনটি রেলস্টেশনে খুলে গেছে ‘ইস্টিশন পাঠাগার’। স্থানীয় তরুণ-তরুণীদের ওপরেই আতিফ দায়িত্ব দিয়েছেন সেই পাঠাগার নিয়ন্ত্রণের। অন্যদিকে নিজে গ্রন্থ সংগ্রহের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন অক্লান্তভাবে।
আজকের প্রযুক্তির দিনে দাঁড়িয়ে ক্রমশ সংকীর্ণ হয়ে আসছে বই পড়ার অভ্যাস। সে ব্যাপারে আক্ষেপ রয়েই গেছে আতিফের। তবে আতিফের বিশ্বাস পাঠাগারের সহজলভ্যতা আবার ফিরিয়ে আনতে পারে সেই হারিয়ে যাওয়া অভ্যেস। এভাবেই যেন নিঃশব্দে এক সাংস্কৃতিক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন আতিফ। জয় আসবেই…
Powered by Froala Editor