শুধু প্রতিবেশী রাষ্ট্রই নয়, পৃথিবীর আরও দুটো জায়গায় লুকিয়ে রয়েছে ‘বাংলাদেশ’

একাত্তর সাল। হাজার হাজার বাঙালির সংগ্রাম নেমে এসেছে ময়দানে। একদিকে পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচার, অন্যদিকে সেসবের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের লড়াই। তাঁদের চোখে একটাই স্বপ্ন— বাংলাদেশ। রক্ত ঝরেছে, অত্যচারিত হয়েছে বহু প্রাণ; সেসবের ভেতর দিয়েই একদিন সূর্য উঠেছিল। নতুন এক দেশ জন্ম নিল পৃথিবীতে, যার নাম ‘বাংলাদেশ’। বাংলার দেশ, বাঙালির দেশ। ম্যাপ খুললেই ভারতের পাশে জ্বলজ্বল করে রয়েছে তারা… 

তবে ‘বাংলাদেশ’ নামটির কি এই একটিই অস্তিত্ব বর্তমান? বিশ্বের বিশাল ম্যাপের ভেতর একটু হাঁটাচলা করলেই দেখা যাবে, বাংলাদেশ কেবলমাত্র একটি দেশের নাম নয়। পৃথিবীতে আরও দুটি জায়গা আছে, যার নাম ‘বাংলাদেশ’। নামে ‘দেশ’ হলেও, এক্ষেত্রে জায়গা দুটির পরিচয় জেলা এবং গ্রাম হিসেবে। কিন্তু এমন নামকরণের কারণ? কী আছে পর্দার আড়ালে? নতুন কোনো ইতিহাস, যার সঙ্গে জুড়ে আছে পদ্মা নদীর দেশটি?

প্রথমে আসা যাক বাংলাদেশ গ্রামের কথায়। এর জন্য বেশি দূরে যেতে হবে না আপনাকে। ভারতের বুকেই রয়েছে অন্য এক বাংলাদেশের অস্তিত্ব। কাশ্মীরের একেবারে উত্তরের একটি গ্রাম বান্ডিপুরা। ভূস্বর্গের দৃশ্য দেখতে দেখতে, এই বান্ডিপুরা থেকে আরও ৫ কিমি দূরে, উলার হ্রদের ধারে রয়েছে এই বাংলাদেশ। কাঁটাতার পেরোতে হবে না, ভিসাও করতে হবে না। সময় সুযোগ করে দিব্যি চলে যাওয়া যায় সেখানে। একে এমন নামের মাহাত্ম্য, তার ওপর অপূর্ব প্রকৃতি এবং মানুষজন— কাশ্মীরের বাংলাদেশ রয়েছে নিজের মহিমা নিয়েই… 

আবারও ফিরে যাওয়া যাক ১৯৭১-এ। পাকিস্তান সেনা এবং হানাদারদের আক্রমণে জর্জরিত ওপার বাংলা। নামেই পূর্ব পাকিস্তান, ভেতরে তখন স্বাধীনতার তীব্র স্পৃহা এবং বাংলার সংস্কৃতিকে রক্ষা করার আকুতি। সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির ঘোষণা বিপ্লবের আগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। এমন সময় কাশ্মীরের নিরালা জায়গায় নিশ্চিন্তে জীবন কাটাচ্ছিল এই গ্রামটি। তখন অবশ্য গ্রামের নাম ছিল ‘জুরিমন’। কিন্তু বাংলাদেশের আগুনের আঁচ পৌঁছে যায় এখানেও। গ্রামের অনেকটা জায়গা আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যায়। দরিদ্র মানুষগুলো নেমে আসে রাস্তায়। 

আরও পড়ুন
খিদে মেটাত মাটির তৈরি বিস্কুট ‘ছিকর’, প্রচলন ছিল প্রতিবেশী বাংলাদেশেই

এবার কী করবে? সকলে মিলে ঠিক করলেন, আবার নতুন করে তৈরি করবেন গ্রাম। আগুনের বুক থেকেই উঠে আসুক ফিনিক্স। আগুন লেগেছে তো কি হয়েছে, বাঁচতে তো অসুবিধা নেই! সবাই মিলে বাড়ি তৈরি শুরু করলেন। যে সময় নতুন করে আবার গড়ে উঠছে জুরিমন, তখন বাংলাদেশও রক্ত আর আগুনের ভেতর দিয়ে জন্ম নিচ্ছে। পাকিস্তানি সেনাদের হারিয়ে দিয়েছে ভারতীয় সেনা ও বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধাদের বাহিনী। ভারতের দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল এই বিজয়ের কাহিনি। এসে পড়ল কাশ্মীরের এই ছোট্ট গ্রামেও। কয়েকশো কিলোমিটার দূরে একটি দেশের লড়াইকে সম্মান জানাতে গ্রামের নাম বদলে দিলেন সবাই। ‘জুরিমন’ বদলে গেল ‘বাংলাদেশ’-এ। 

সেই থেকে আজও বাংলাদেশ বেঁচে আছে কাশ্মীরে। জনতার ভিড় থেকে একটু আড়ালে, নিরালায় কাটছে তাদের জীবন। আধুনিকতাও ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছে এখানে। কাশ্মীরি সৌন্দর্য আর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছে বাংলাদেশ… 

আরও পড়ুন
আঙুলের ছাপ নেই তিন প্রজন্মের – বাংলাদেশেই আছে বিস্ময়কর পরিবার

এ তো গেল বাংলাদেশ গ্রামের কথা। এছাড়াও যে আস্ত একটি জেলা আছে একই নামে! তবে তার জন্য কাঁটাতার পেরিয়ে যেতে হবে পশ্চিমে, আর্মেনিয়ায়। কাস্পিয়ান সাগরের ধারে এই সুন্দর দেশটির রাজধানী ইয়েরেভানেরই একটি জায়গার নাম বাংলাদেশ। কাশ্মীরের মতো নির্জন নয়; বরং অনেক জনবহুল। দিন রাত লোকের আনাগোনা লেগেই আছে। খাওয়া-দাওয়া, ঘোরা সবকিছু নিয়ে প্রাণবন্ত আর্মেনিয়ান ‘বাংলাদেশ’। 

অবশ্য এর প্রকৃত নাম ‘মালাতিয়া সেবাস্তিয়া’। কিন্তু সে তো সরকারি কাগজে। স্থানীয়রা ‘বাংলাদেশ’ বলে ডাকতেই ভালোবাসেন। শুধু জায়গার নামেই ক্ষান্ত নয়; এখানকার বাসিন্দারাও নিজেদের পরিচয় দেন একজন ‘বাংলাদেশি’ হিসেবেই! অবশ্য বাংলাদেশেও যে রয়েছে ‘আরমানিটোলা’। দুই জায়গার ইতিহাস তো আজকের নয়! অবিভক্ত বাংলার বুকে বারবার এসেছেন আর্মেনিয়ানরা। যাই হোক, ইয়েরেভানের এই জেলার নামকরণের পিছনেও আছে মুক্তিযুদ্ধ। আছে আরও এক স্বাধীনতার কাহিনি… 

আরও পড়ুন
শুধু পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশ নয়; আফ্রিকার এই দেশটিরও সরকারি ভাষা বাংলা

আর্মেনিয়ার ইতিহাসেও রয়েছে দীর্ঘদিনের সংগ্রামের কাহিনি। লড়াই করে, রক্ত ঝরিয়ে স্বাধীনতা আদায় করেছে তাঁরা। কিন্তু স্বাধীন হলেও, আর্মেনিয়াকে প্রথমে স্বাধীন, স্বতন্ত্র দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি পাকিস্তান। এদিকে বাংলাদেশের কাহিনি তখন গোটা বিশ্বে প্রসিদ্ধ। সেই দেশকে সম্মান জানাতে এবং পাকিস্তানের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে রাজধানীর অন্যতম একটি জেলা মালাতিয়া সেবাস্তিয়ার নামকরণ করা হয় ‘বাংলাদেশ’। অনেকে মনে করেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সম্মান জানাতেও এই নামকরণ করা হয়। যে কারণই হোক, প্রেক্ষাপটে জ্বলজ্বল করছে সবুজ মাঠ আর লাল সূর্যের দেশটি। যেখানে দূরত্ব নয়; সম্মান, ইতিহাস আর বিপ্লবই হল সাঁকো… 

তথ্যসূত্র- ডিবিসি নিউজ 

Powered by Froala Editor