চতুর্দিকে ধানের ক্ষেত, জলাজমি। তারই মাঝে মাথা উঁচু করে জেগে রয়েছে প্রকাণ্ড এক স্থাপত্য। না, বিলাসবহুল কোনো বাগানবাড়ি নয়। এটি একটি হাসপাতাল। বাংলাদেশের প্রান্তিক গ্রাম সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকা সোয়ালিয়ায় নির্মিত এই হাসপাতালই এবার জিতে নিল বিশ্বের সেরা সাম্প্রতিক স্থাপত্যের তকমা।
ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল— ৮০ শয্যা বিশিষ্ট বাংলাদেশের (Bangladesh) এই প্রান্তিক কমিউনিটি হাসপাতালকেই (Community Hospital) সম্প্রতি সেরার মুকুট দিয়েছে রয়্যাল ইনস্টিটিউট অফ ব্রিটিশ আর্কিটেক্টস (Royal Institute Of British Architects)। উল্লেখ্য, এই প্রথম বাংলাদেশের কোনো স্থাপত্যের মুকুটে জুড়ল এহেন আন্তর্জাতিক পুরস্কার। স্বাভাবিকভাবেই কৌতূহল জন্মানোর কথা, বিশেষত্ব কি এই হাসপাতালের? কেনই বা সেরার তকমা দেওয়া হল তাকে?
ভৌগলিক অবস্থানের নিরিখে দেখতে গেলে সাতক্ষীরা উপকূলবর্তী অঞ্চল হওয়ায়, তা অত্যন্ত ঘূর্ণিঝড়প্রবণ। প্রতিবছরই এক বা একাধিক বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ের সম্মুখীন হয় এই প্রান্তিক গ্রাম। ঝড়-পরবর্তী সময়ে ভয়ঙ্কর প্রতিকূল হয়ে ওঠে গোটা অঞ্চলটার পরিস্থিতি। ফলে, সেই বাধা টপকে এমন একটি স্থাপত্যকে দাঁড় করানোই ছিল স্থাপত্যশিল্পীদের প্রধান চ্যালেঞ্জ। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতেও যাতে এই ধরনের ঝড়ের মোকাবিলা করতে পারে এই নির্মাণ, সে-কথাও মাথায় রাখতে হয়েছে তাদের।
তবে শুনলে অবাক হতে হয়, শুধুমাত্র এই গ্রামে তৈরি সাধারণ ইটের মাধ্যমেই তৈরি করা হয়েছে আস্ত নির্মাণটি। পাশাপাশি গোটা নির্মাণটি দাঁড়িয়ে রয়েছে ইটের তৈরি স্তম্ভের ওপরে। ফলে, বন্যা কিংবা ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে তা ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। মাইক্রো-ক্লাইমেটের পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে হাসপাতালের মধ্যেই তৈরি করা হয়েছে একটি খাল। যা পারতপক্ষে বৃষ্টির জল সংরক্ষণে সাহায্য করে। সেইসঙ্গে গরমকালে নিয়ন্ত্রণ করে হাসপাতালের পরিবেশের তাপমাত্রাও। আশেপাশের জলাভূমিতে লবণাক্ত জলের আধিক্যের কারণে প্রায় অব্যবহার যোগ্য সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ জলও। হাসপাতালের ভিতরে অবস্থিত খালের জলকে পরিস্রুত করেই, সেই জলের চাহিদা মেটানো হয় এই হাসপাতালে। তাছাড়া বৈদ্যুতিক জেনারেটর, অ্যাম্বুলেন্স, ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসা পরিষেবা— এসব তো রয়েছেই।
আরও পড়ুন
চতুর্থ ভারতীয় হিসাবে রামানুজন পুরস্কার পেলেন কলকাতার নীনা
২০১২ সালে বাংলাদেশের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘ফ্রেন্ডশিপ এনজিও’ উদ্যোগ নিয়েছিল এই হাসপাতাল নির্মাণের। ২০১৩ সাল থেকে শুরু হয় নির্মাণ কার্য। যার নেপথ্যে রয়েছেন বাংলাদেশের স্থপতি কাশেফ চৌধুরী। ২০১৮ সালে প্রাথমিক নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পরেই খুলে দেওয়া হয়েছিল হাসপাতালের দরজা। গত বছর থেকে সম্পূর্ণভাবে চালু হয়ে যায় হাসপাতালটি। বর্তমানে ৬ জন চিকিৎসক, ১২ জন নার্স এবং আরও বেশ কয়েকজন সহকারী নিয়েই চলছে সাতক্ষীরার এই হাসপাতাল।
আরও পড়ুন
পরিবেশরক্ষায় অবদান, বিশেষ পুরস্কার পেল কলকাতার জল-জাদুঘর
প্রান্তিক অঞ্চলে এমন অত্যাধুনিক চিকিৎসা পরিষেবা এর আগেই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল গোটা বিশ্বের। এবার তার মুকুটে জুড়ল আরও একটি নতুন পালক। রয়্যাল ইনস্টিটিউট অফ ব্রিটিশ আর্কিটেক্টস আন্তর্জাতিক পুরস্কারের জন্য প্রাথমিকভাবে বেছে নেওয়া হয়েছিল সাম্প্রতিক সময়ে নির্মিত তিনটি স্থাপত্যকে— বার্লিনের একটি গ্যালারি, ডেনমার্কের একটি ফুটব্রিজ ও সাতক্ষীরার সংশ্লিষ্ট হাসপাতালটি। তার মধ্যে থেকে বাংলাদেশের এই হাসপাতালটিকে সেরা স্থাপত্য হিসাবে বেছে নেন কিংবদন্তি স্থপতি ওডাইল ডেক। ডেকের অভিমত, আগামীতে প্রান্তিক অঞ্চলে অত্যাধুনিক পরিকাঠামো তৈরিতে মডেল হয়ে পথ দেখাবে সাতক্ষীরার এই হাসপাতাল…
আরও পড়ুন
১৯৫৯ সালের গণিত-ধাঁধা সমাধান করে পুরস্কার ভারতীয় বংশোদ্ভূতের
Powered by Froala Editor