ঘরের দেওয়ালে সিমেন্টের প্রলেপ পড়েনি। ইট-গাঁথুনির পাঁজর বার করা শরীরেই সেই ঘর দিব্যি ধারণ করে আছে একটি পাঠকক্ষকে। নীলরঙা সারি সারি আলমারিতে সাজানো রয়েছে বই। দেখলেই বোঝা যায়, এটা একটা পাঠাগার। বয়স তাও নয় নয় করে চব্বিশ। চাকচিক্যহীন এই ঘরেই পালিত হয় নানা কর্মসূচি, আয়োজিত হয় আলোচনাচক্র। করোনার পরিস্থিতিতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে দাঁড়ি পড়লেও পাঠাগারের কর্মীরা নিজেদের সামাজিক দায়িত্ব ভুলে যান না। ঘরের মেঝেতে বসেই অভাবী মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় রসদ গুছোতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন তাঁরা। আসলে পাঠাগারটি যাঁর নামে, সেই মানুষটির স্বল্পায়ু জীবনের বড় অংশই যে নিয়োজিত হয়েছিল সমাজ-সেবায়।
সোমেন চন্দ পাঠাগার। বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্য-শহীদের নামাঙ্কিত পাঠাগারের কর্মীরা সকলেই তাঁর আদর্শকে বহন করে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। পাঠাগারের অর্থ সম্পাদক রিপন চক্রবর্ত্তী পার্থর মুখেও উঠে আসে সেই কথা – ‘আমরা ওনার আদর্শকে ধারণ করি। শত প্রতিকূলতার মাঝেও অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিনির্মাণে কাজ করে চলেছি আমরা। ফলে, প্রতিনিয়ত সাম্প্রদায়িক রোষানলে পড়তে হয়।’ রিপনের কথাতেই পরিষ্কার, পৃথিবীর সর্বত্রই যুক্তিবাদী ও ধর্মান্ধদের সংঘর্ষের চিত্রটা একই।
ঢাকার ৫০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে নরসিংদি জেলার পলাশ উপজেলার সুলতানপুরের গুদারাঘাট এলাকায় দুশোর মতো বই ও কুড়ি-পঁচিশজন পড়ুয়াকে নিয়ে এই পাঠাগারটির পথচলা শুরু হয়েছিল ১৯৯২ সালের ১২ ডিসেম্বর। তখন নাম ছিল ‘হাসনা হানা পাঠাগার’। তারপর ১৯৯৬ সালে নাম বদলে রাখা হয় ‘সোমেন চন্দ পাঠাগার’। বর্তমানে এই পাঠাগারটি জেলা পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। বইয়ের সংখ্যা তিন হাজারেরও বেশি আর স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী ও সাধারণ পাঠক মিলিয়ে সংখ্যাটা প্রায় সাতশো। সূচনার সময় থেকেই সোমেন চন্দের সাহিত্য, তাঁর রাজনৈতিক জীবনচর্চাকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে নানাবিধ কর্মসূচি নিয়ে আসছে পাঠাগার। বাদ যায় না পরিবেশ-সচেতনতাও। জন্মশতবর্ষে একটি নতুন সংকলনও প্রকাশ করার কাজ করছেন তাঁরা। দেশে-বিদেশে সোমেনের চর্চা ছড়িয়ে পড়ুক, এমনটাই চান তাঁরা।
এই সুলতানপুরের পাশের গ্রাম বালিয়ায় ছিল সোমেনের পৈতৃক ভিটে। সেই ভিটের অবস্থা বর্তমানে ভগ্নপ্রায়। তার উপর রয়েছে জবরদখলের চোখরাঙানি। তবে পাঠাগারের মূল উদ্যোক্তা ও সভাপতি শহীদুল হক সুমনের কাছ থেকে জানা গেল – ‘ওনার যে আত্মীয়স্বজনরা এখনও আছেন, তাঁদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। ভিটের কাছাকাছি ওনার নামে একটি স্মৃতিফলক আমরা স্থাপন করব। এই বিষয়ে পৌরসভায় আমরা আবেদনও করেছি। ওনার ভাতিজা মানিক চন্দ এবং অন্যান্যরা মিলে রাস্তার কাছাকাছি একটি স্থানও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এই জন্মশতবর্ষে সেটাই আমাদের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু এই করোনার জন্য এখন সব কাজই বন্ধ।’
এই করোনার কারণেই আরও বড় একটি ক্ষতি হয়ে গিয়েছে তাঁদের। কয়েকদিন আগেই করোনার উপসর্গ নিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন মানিকবাবু। তাঁকে বাঁচানো যায়নি। সোমেন চন্দের ভাই কল্যাণ চন্দের পুত্র ছিলেন তিনি, থাকতেন নারায়ণগঞ্জে। বালিয়াও একসময় নারায়ণগঞ্জ সাব ডিভিশনেরই অন্তর্গত ছিল। সোমেন নিজে অবশ্য বালিয়ায় সেভাবে থাকেননি। তাঁর পড়াশোনা ও কর্ম সবই ঢাকায়। ফলে, সোমেনের সাহিত্যকর্মে ঢাকার জীবন, রাজনীতি, ঘটনা সবই মিলেমিশে গেছে।
বিপ্লবী বিনয় বসুর লোম্যান-হত্যার স্মৃতি বহন করছে যে প্রতিষ্ঠান, ঢাকার সেই মিটফোর্ড মেডিক্যাল কলেজেরই ছাত্র ছিলেন সোমেন। তাঁর বাবা ছিলেন এই কলেজ হাসপাতালের রিসিভিং ক্লার্ক। কিন্তু, ডাক্তারি পড়াশোনায় উৎসাহ পাননি সোমেন। শারীরিকভাবেও খুব শক্তিশালী ছিলেন না। পরিণাম, ডাক্তারি পরীক্ষার প্রথমবর্ষে অকৃতকার্য এবং চিরতরে ইতি। এ অবশ্য তাঁর পক্ষে শাপে বরই হয়েছিল। প্রথমত, স্বাধীন পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছিলেন। টি. এস. এলিয়ট, স্টিফেন স্পেন্ডার, ভার্জিনিয়া উলফ, অ্যাল্ডস হাক্সলে, ম্যাক্সিম গোর্কি, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, পার্ল বাক, টমাস ম্যানের লেখা পড়ে ফেলেছেন। পড়ে ফেলেছেন বনামি ডব্রি ও জর্জ আর্নেস্ট ম্যানওয়ারিং-এর ‘দ্য ফ্লোটিং রিপাবলিক’, ক্রিস্টোফার কডওয়েলের ‘ইল্যুশন অ্যান্ড রিয়্যালিটি’, রোমাঁ রোলাঁর ‘আই উইল নট রেস্ট’। দ্বিতীয়ত, খুব অল্প বয়স থেকেই সমাজসেবায় নিয়োজিত করতে পেরেছিলেন নিজেকে। সতেরো বছর বয়স থেকেই তাঁর সাংগঠনিক কাজের দক্ষতা ছিল ঈর্ষণীয়। ঢাকার যে অঞ্চলে তিনি থাকতেন, সেই দক্ষিণ মৈশুণ্ডিতে প্রতিষ্ঠা করেন ‘প্রগতি পাঠাগার’। তার পরিচালনা থেকে শুরু করে নানাবিধ উদ্যোগ নেওয়া, সবেতেই সোমেন।
ডাক্তারি পড়ায় অকৃতকার্য হওয়ায় পিছনে তাঁর যে শারীরিক দুর্বলতাকে কারণ হিসেবে দর্শান অনেক সমালোচক ও জীবনীকার, তা আংশিক সত্য। শারীরিক দুর্বলতা তাঁর ছিল ঠিকই, কিন্তু যে কর্মব্যস্তময় জীবন তিনি বেছে নিয়েছিলেন তা ছিল আরও বেশি পরিশ্রমের, এবং সেখানে ক্লান্তির ছাপ দেখা যায়নি। তাঁর বয়ান থেকেই জানা যায়, দুর্বল হওয়ার কারণে নেতৃত্ববর্গ তাঁর পরিশ্রম করার ক্ষমতা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু শান্ত অথচ জেদি ছেলেটির অধ্যবসায়ের কাছে তাঁদের সন্দেহ ধোপে টেকেনি। তাঁর তীক্ষ্ণ, যুক্তিপূর্ণ বাচনভঙ্গি, মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়ার সহজাত স্বভাব শ্রমজীবী শ্রেণীর মানুষের কাছে বিশেষ গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল। আবার এই গুণের কারণেই মালিকশ্রেণী রীতিমতো ভয় করত সদ্যযুবা সোমেনকে।
সদ্য ঘটে যাওয়া স্পেনের গৃহযুদ্ধ তাঁকে প্রবলভাবে নাড়িয়েছিল। ফ্রাঙ্কোর ফ্যাসিবাদীদের হাতে শহীদ ফ্রেদরিকো গার্সিয়া লোরকা, র্যা লফ ফক্স, জন কনফোর্ড, ক্রিস্টোফার কডওয়েলের কথা উঠে এসেছে তাঁর কবিতায়। সেলুলার জেল-ফেরত সতীশ পাকড়াশী তাঁকে এঁদের কথা বলেন। অপার বিস্ময়ে সোমেন শুনলেন, কীভাবে ‘ধন-শোষণমত্ত ফ্যাসিস্ট বর্বরতার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে কবি ও সাহিত্যিকগণ স্পেনের আন্তর্জাতিক বাহিনীতে ছুটে গিয়েছিলেন।’ বিশ্বব্যাপী লাঞ্ছিত মানুষের কথা ফুটিয়ে তোলার মধ্যেই বুঝি আসে নির্ভীক সাহিত্যসৃষ্টির প্রেরণা। সেই প্রেরণা সোমেন পেয়েছিলেন একথা একশো শতাংশ সত্য। তাই নিজেও বিশ্বাস করতেন, সাহিত্যসৃষ্টি কেবল শিল্পের জন্য নয়, সাহিত্যের বিরাট দায়িত্ব রয়েছে সমাজের প্রয়োজনে। আবার যেহেতু তিনি সহজাত-শিল্পী, সেহেতু তাঁর গল্পে গভীর স্বদেশ-চেতনা যেমন রয়েছে, তেমন রয়েছে মানবমনের সূক্ষ্ম অনুভূতিও। আরও বিস্ময়কর যে, এমন বহু গল্পই তিনি লিখে ফেলেছেন কুড়ি বছর পার হওয়ার আগেই। ‘ভালো-না-লাগার শেষ’, ‘অমিল’, ‘সত্যবতীর বিদায়’, ‘গান’, ‘প্রত্যাবর্তন’, ‘মহাপ্রয়াণ’, ‘বনস্পতি’-র মতো গল্প সবই লেখা ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০-এর মধ্যে। এই সময়েই লেখা (১৯৩৮) উপন্যাস ‘বন্যা’তেও শ্রেণী-চেতনার ক্ষেত্রে তিনি যে ক্ষুরধার পরিণতবোধ দেখিয়েছেন, তা আজকের যুগে দাঁড়িয়েও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। আবার শব্দচয়নের মুন্সিয়ানা, চমকের সার্থক প্রয়োগে রয়েছে সাহিত্যিক উৎকর্ষতা।
সমাজ-সাহিত্য সম্পৃক্ত এমন ভাবনা থেকেই ‘প্রগতি পাঠাগার’-এর প্রতিষ্ঠা ও পরে ‘প্রগতি লেখক সংঘে’ যোগদান। এই লেখক সংঘের প্রতিষ্ঠার ইতিহাসটিরও আন্তর্জাতিক পটভূমিকা রয়েছে। ১৯৩৩ সালের ১০ মে হিটলারের জার্মানিতে যে বই-দহন উৎসব চলে, তার বিরুদ্ধে তখনকার দিকপাল লেখকগণ সকলকে এককাট্টা করে তোলেন। প্যারিস, লন্ডন, ইউরোপের এমন বিভিন্ন স্থানে সংগঠিত হতে থাকে লেখকদের সম্মেলন। পুরোভাগে ছিলেন রোমাঁ রোলাঁ, আঁদ্রে জিদ, ম্যাক্সিম গোর্কি, হার্বার্ট রিড, মুলকরাজ আনন্দের মতো সাহিত্য-ব্যক্তিত্বরা। ১৯৩৫ সালে লখনৌতে স্থাপিত হয় ‘নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘ’, যার বঙ্গীয় শাখার অন্যতম প্রশাখাদুটির একটি ছিল কলকাতায়, অন্যটি ঢাকায়। ১৯৩৯ সালে কলকাতার শাখা থেকে সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামী ও হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হল সংকলনগ্রন্থ ‘প্রগতি’ আর ঢাকার শাখা থেকে প্রকাশিত হল ‘ক্রান্তি’। ‘ক্রান্তি’-র প্রকাশক ছিলেন সোমেন চন্দ স্বয়ং। এই সংকলনে তাঁর ‘বনস্পতি’ গল্পটি স্থান পেয়েছিল।
প্রগতি লেখক সংঘ বর্তমানেও বাংলাদেশে ভীষণভাবে সক্রিয়। কয়েকবছর নিষ্ক্রিয় থাকার পর আবার শুরু হয়েছে তার কাজ। ঢাকায় সোমেন ও আশির দশকে শহীদ হওয়া ট্রেড ইউনিয়ন নেতা তাজুল ইসলামের নামে গড়ে ওঠা ‘সোমেন-তাজুল পাঠাগারে’ স্থাপন করা হয়েছে এই সংঘের কেন্দ্রীয় কার্যালয়। সংঘের কেন্দ্রীয় নেতা অভিনু কিবরিয়া ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান – ‘সোমেন চন্দ প্রগতি লেখক সংঘে যে কাজগুলি করতেন, তাঁর সেই চিন্তা-চেতনাকে আদর্শ করেই আমরা এখানে কাজ শুরু করেছি। তিনি যে সমাজের স্বপ্নটা দেখেছিলেন, সেই সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, সমাজের প্রতি লেখকের দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে, আমরা কাজ করার চেষ্টা করছি। বাংলাদেশের প্রায় বিশটির মতো জেলায় আমাদের সংগঠন সক্রিয় আছে, নানারকম কাজ করছে। জন্মশতবর্ষে বেশ কিছু কর্মসূচি আমাদের ছিল, কিন্তু করোনার কারণে আটকে গেছে সব। তবে একটি কর্মসূচি আমরা বাস্তবায়িত করতে পেরেছি। আমাদের ইচ্ছা ছিল, বিভাগীয় স্তরে সোমেন চন্দের নামে একটি সাহিত্য সম্মেলন আমরা করব। এবছরই ঢাকা বিভাগীয় সোমেন চন্দ সাহিত্য সম্মেলন আমরা করেছি। এটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল নারায়ণগঞ্জে। ঢাকা বিভাগের বেশ কিছু কর্মী সেখানে অংশগ্রহণ করেন। সেই উপললক্ষ্যে আমরা প্রকাশনাও বের করেছিলাম। এই করোনা পরিস্থিতি কেটে গেলে অন্যান্য বিভাগীয় পর্যায়েও সোমেন চন্দের নামে সাহিত্য সম্মেলন করার ইচ্ছা আছে আমাদের। একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন করারও ইচ্ছা ছিল, তবে জানি না, তা কতটা সম্ভব হবে। সোমেন চন্দকে আমরা ধরে রাখতে চাই আমাদের কাজের মাধ্যমেই।’
ঢাকার যে রাস্তায় তাঁকে হত্যা করা হয়, লক্ষ্মীবাজারের কাছের সেই হৃষিকেশ দাস লেনে প্রতিবছর তাঁর হত্যাদিবসে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে প্রগতি লেখক সংঘ ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক সংগঠন। ’৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অস্থির পরিস্থিতিতে নাৎসি জার্মানির হাতে আক্রান্ত সোভিয়েতের পাশে দাঁড়ানো উচিত, নাকি এই সুযোগে তীব্র ব্রিটিশ-বিরোধিতাই একমাত্র লক্ষ্য, এই প্রশ্নে চরম দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল মার্কসবাদী ও জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে। তারই মর্মান্তিক পরিণতি জাতীয়তাবাদীদের হাতে সোমেনের বীভৎস মৃত্যু। ’৪২-এর ৮ মার্চ সূত্রাপুরের সেবাশ্রমের প্রাঙ্গণে ফ্যাসি-বিরোধী যে সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল, সেই সম্মেলনে যোগ দিতেই রেলকলোনি থেকে রেলশ্রমিকদের মিছিল নিয়ে আসছিলেন তিনি। নেতা হিসেবে পুরোভাগে সোমেনই ছিলেন। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে যেভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়, তা নিয়ে তাঁর বন্ধু ও কবি সরলানন্দ সেন লিখেছেন – ‘এতবড় মহাভারতের মধ্যে একমাত্র অভিমন্যু বধেই তাহার নজির মেলে।’
সোমেনের মৃত্যু তৎকালীন বাংলার সংস্কৃতি ও বুদ্ধিজীবী মহলকে কতখানি নাড়া দিয়েছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে, এই ঘটনার দিন পনেরো পরে ২৩ মার্চ আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত বিশিষ্ট জনদের যৌথ বিবৃতিতে – ‘…সোমেন চন্দ একজন উদীয়মান ও বিশিষ্ট লেখক ছিলেন। তিনি যে মাত্র লেখক ছিলেন তাহা নয়, তিনি তাঁহার নিজের চিন্তাধারার সহিত সামঞ্জস্য রাখিয়া অনুরূপভাবে দেশের ও দশের সেবায় যে যুক্ত হইয়াছিলেন, তাহাতেই তাঁহার উৎকর্ষতা সূচিত হইতেছে। ফ্যাসিবাদের কুৎসিত মূর্তি দেখিয়া প্রত্যেক দেশের সাহিত্যিকরা ফ্যাসিবাদের প্রতি নিজেদের ঘৃণা জানাইয়াছেন।…’ বিশিষ্ট জনদের মধ্যে ছিলেন প্রমথ চৌধুরী, ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী, অতুলচন্দ্র গুপ্ত, আবু সৈয়দ আয়ুব, প্রমথনাথ বিশী, সুবোধ ঘোষ, হিরণকুমার সান্যাল, সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ দিকপাল ব্যক্তিত্বরা।
ওই অল্প বয়সেই সোমেনের যা কর্মকাণ্ড, তাতে তাঁর মধ্যে ভবিষ্যতের জননেতা এবং একইসঙ্গে বিশিষ্ট সাহিত্যিক হয়ে ওঠার সমস্ত সম্ভাবনা ছিল, একথা অনস্বীকার্য। অথচ, ঘাতকের হাতে মাত্র একুশ বছর সাড়ে ন’মাস বয়সে শেষ হয়ে যাওয়া নশ্বর মানবজীবনের নিয়তি হল বিস্মৃতি। জন্মশতবর্ষে তাঁকে আদৌ কতটা মনে রেখেছে বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্ম? কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে সেই বিষয়ে বেশ আশার কথাই শোনা গেল। ঢাকার দ্যু প্রকাশনী থেকে এবছরের একুশে বইমেলায় লেখক এম. এ. আজিজ মিয়ার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে ‘সোমেন চন্দ গল্পসঞ্চয়ন’। তাঁর লেখা যে পঁচিশটি গল্প এখনও অবধি বিভিন্ন সংকলনে পাওয়া যায়, তার বাইরে আরও চারটি গল্প এখানে যুক্ত হয়েছে। প্রকাশক হাসান তারেখ জানালেন, তরুণ প্রজন্মের পাঠকদের মধ্যে বইটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে সোমেনের চর্চাকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জিইয়ে রেখেছেন যাঁরা, তাঁদের অন্যতম শহীদুলভাইও একই কথা বলেন। তবে, সোমেনের রাজনৈতিক দর্শনের দিকটি নিয়ে খুব বেশি উৎসাহ দেখা যায় না, এমনটাও বললেন তিনি। বর্ষীয়ান সোমেন-গবেষক শফিউদ্দিন আহমেদের কথা অনুযায়ী, সোমেনকে নিয়ে গবেষণার বিষয়ে তেমন উৎসাহ এখনও নেই এই প্রজন্মের গবেষকদের। তবে শতবর্ষকে কেন্দ্র করে জনমানসে পরিচিতি বাড়লে সেদিকেও উৎসাহ আসবে এমনটা ধরে নেওয়াই যায়।
করোনাপ্রবর কাটিয়ে আবার কবে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরবে জনজীবন, জানেন না কেউই। সোমেনকে নিয়ে পরিকল্পিত একাধিক কর্মসূচি থমকে রয়েছে তাঁদের। বিশ্বজুড়ে নব্য ফ্যাসিবাদীরা এই সুযোগে আরও বেশি সুবিধাভোগের রাজনীতিতে মত্ত। সবদিক দিয়ে চূড়ান্ত ভয়ঙ্কর এই সময়ে সোমেন নিজে আজ উপস্থিত থাকলে কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করে হয়তো একাই রাস্তায় নামতেন, সমাজবিচ্ছিন্ন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিতেন ধারালো প্রশ্ন – ‘আপনি রোলাঁর ‘আই উইল নট রেস্ট’ পড়েছেন?’
(ছবি সৌজন্যে রিপন চক্রবর্ত্তী পার্থ এবং অভিনু কিবরিয়া ইসলাম)