পত্রিকার শুরুতেই দেবনাগরীতে লেখা "কন্যাপেবং পালনীয়া।" নিচে বঙ্গানুবাদ করে বলা- ''কন্যাকে পালন করিবেক এবং যত্নের সহিত শিক্ষা দিবেক।''
অনেকটা আজকের স্লোগানের মতোই শুনতে লাগে- বেটি পড়াও, বেটি বাঁচাও। দেড়শো বছর পেরিয়েও আমরা একই অবস্থানে থেকে গেলাম। আশ্চর্য লাগে! তবে হ্যাঁ, আজকালের এই স্লোগানের মতো পত্রিকার ওই লেখাটি শুধুই কথার কথা ছিল না। পত্রিকাটির নাম বামাবোধিনী। নামের মর্যাদা যাতে অক্ষুণ্ন থাকে, তার চেষ্টায় কোনো ত্রুটি সে রাখেনি কখনও।
আরও পড়ুন
৪,৩০০ বছর আগেকার মন্ত্র খোদাই পাথরে, বিশ্বের প্রাচীনতম লেখক এক নারী
সময়টা একার্থে নবজাগরণের। সবদিক থেকে আন্দোলন না হলেও, একটা ধাক্কাধাক্কি তো হয়েছিল। তার গুরুত্বও কম নয়। অন্তত আজকের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে উনিশ শতকটাকে অদ্ভুত উজ্জ্বল মনে হয়। ধর্মীয় গোঁড়ামিগুলোকে ধরে ধরে প্রশ্ন করা তো সেই সময়েই। আর নারীমুক্তি - তারও তো শুরুয়াৎ উনিশ শতকের হাত ধরে। রামমোহনের চেষ্টায় সতীদাহ বন্ধ হল। বিদ্যাসাগর মেয়েদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করলেন। চারদিকে হৈহৈ রব। সমাজ জুড়ে নতুন কিছু লেগেই আছে। উমেশচন্দ্র দত্ত এই নতুনের তাগিদেই প্রকাশ করলেন বামাবোধিনী পত্রিকা। ১৮৬৩ সালের আগস্ট মাসে পত্রিকাটি পথচলা শুরু করল। ভূমিকায় লেখা হল - ঈশ্বরচন্দ্রের প্রচেষ্টায় নারীশিক্ষার পথ কাটা হয়েছে ঠিকই। কিন্তু ইস্কুলের শিক্ষাই যথেষ্ট নয়। অন্দরমহলের চৌহদ্দিতে শিক্ষাকে প্রবেশ করাতে হবে। লেখা হল, নারী শিক্ষাগ্রহণের সময় পায় না। শিক্ষার সঙ্গে তাদের দূরত্ব ঢের। তাই শিক্ষালাভে তাদের তেমন আগ্রহও নেই। তাই পত্রিকা। শিক্ষার আঙিনায় নারীকে টেনে আনার জন্যে, তার সমস্তরকম মানসিক উন্নতির চেষ্টায় পত্রিকাটি প্রকাশ হয়। সবথেকে বড়ো ব্যাপার, পত্রিকাটি চলেছিল দীর্ঘ ষাট বছর। আর এই ষাট বছরে নারীকে ভাষাজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাস, জীবনচরিত, বিজ্ঞান, নীতি, ধর্ম ও আরো নানা বিষয়ে শিক্ষিত করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে সাফল্যের সঙ্গে।
এর আগে সম্বাদ ভাস্কর ও আরও বেশকিছু পত্রিকায় নারীবিষয়ক লেখালেখি প্রকাশিত হয়েছিল। তাদের ওপর সামাজিক অত্যাচারের বিষয়গুলি উঠে এসেছিল সেখানে। প্যারীচাঁদ মিত্র ও রাধানাথ শিকদারের সম্পাদনায় নারীশিক্ষা-বিষয়ক পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৫৪ সালে। কিন্তু খুব দ্রুতই তার আয়ু ফুরোয়। কিন্তু উমেশচন্দ্র দত্তের এই পত্রিকা সেদিক থেকে অত্যন্ত সফল। উমেশচন্দ্র ছিলেন ব্রাহ্ম। প্রথমদিকে কেশব সেনের অনুসারী হলেও পরে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের অংশ হয়ে পড়েন। পত্রিকা প্রকাশে ব্রাহ্মসমাজের সাহায্য পেয়েছিলেন তিনি। ক্ষেত্রমোহন, বসন্তকুমার দত্তের সহযোগিতায় দীর্ঘ চুয়াল্লিশ বছর তিনি পত্রিকাটির সম্পাদনা করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পরে সম্পাদক বদল হয়।
আরও পড়ুন
ব্রিটিশ আমলেও চুটিয়ে ফটোগ্রাফি করতেন বাঙালি মহিলারা
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে গিয়ে মেয়েদের শিক্ষিত করে তোলার এই উদ্যোগ - আজও অবাক করে। পত্রিকাটির একটি সংখ্যায় লেখা হয়েছিল-
"চিরদিন পরাধীন কারাবাসী-প্রায় / একেতে অবলা হায় জ্ঞানহীনা তায় / মানুষ হইয়া অন্ধ পশুমতো রয় / নারীর সমান দীন ভারতে কে হয়…?এই জায়গা থেকেই বামাবোধিনী-তে বড়ো অংশ জুড়ে থাকত জ্ঞানবিজ্ঞান ও কুসংস্কার সম্পর্কিত আলোচনা। দীর্ঘ ষাট বছরের এমন একটি সফল উদ্যোগে জুড়ে ছিলেন সেসময়ের অনেক নারী সাহিত্যিক- রাসসুন্দরী দেবী থেকে শুরু করে জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, সরলা দেবী, স্বর্ণকুমারী দেবী, বেগম রোকেয়া প্রমুখ। বোঝাই যায়, ব্যক্তিগত লেখালেখিকেও, নারীর নিজস্ব স্বরকে তুলে ধরতেও ত্রুটি রাখেনি বামাবোধিনী।
আরও পড়ুন
জাপানে পা রাখা প্রথম ‘বাঙালি বউ’ যোগ দিয়েছিলেন আজাদ হিন্দ বাহিনীতেও
সঙ্গে থাকত পারিবারিক চিকিৎসা পদ্ধতি, শিশুসুরক্ষার বিষয়ও। পরিবারের দেখাশোনার বিষয়টি অবশ্য আজকালকার মেয়েদের বাজারচলতি পত্রিকাগুলিরও একটা আবশ্যিক অঙ্গ।
উনিশ শতকে নারীশিক্ষার সূচনা-মুহূর্তটি বা বিধবাবিবাহ ইত্যাদি নিয়ে বেশকিছু বিতর্ক আজ কান পাতলে শোনা যায়। মানে এইসব পদক্ষেপে নারীমুক্তির বিষয়টি থাকলেও তার গর্ভে নাকি লীন হয়েছিল পিতৃতান্ত্রিক সমাজকাঠামোটি। তা অবশ্য সেই প্রথম যুগে খুব অস্বাভাবিকও নয়। সেসবেরই সূত্র ধরে বামাবোধিনী পত্রিকা। শুধু যে আইন দিয়ে নারীর প্রকৃত এগিয়ে আসা সম্ভব নয়, তা সেদিন বুঝেছিলেন উমেশচন্দ্র। তাই এই গঠনমূলক প্রচেষ্টা৷ আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারীদিবসে এই পত্রিকাটিকে নতুন করে ফিরে দেখা যেতে পারে। অন্তত আমাদের দেশ ও সমাজের নিরিখে। আজকের অনেক ঝাঁ-চকচকে ‘মেয়েদের কাগজ’, ‘মেয়েদের টিভি চ্যানেল’এর তুলনায় বামাবোধিনী-কে আধুনিক বলে মনে হবে। অন্তত প্রসাধনী, ফ্যাশানেবল পোশাক-আশাকের বৃত্তে সে আটকে ছিল না। যতই সে পুরোনো পত্রিকা হোক, আমাদের তার চেয়েও বেশি প্রাচীন মনে হয়। উদার মুক্ত সমাজের জন্যে যে চলাটি সে যুগে শুরু হয়েছিল, আমাদের পথ সেখান থেকে অনেকদূরে বেঁকে গেছে।
Powered by Froala Editor