২৫ মার্চ। সালটা ১৯৭১। কেউ গভীর ঘুমে, কেউ আড়মোড়া ভেঙে কাজে নামার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। আপাত নিরুত্তাপ সময়। কিন্তু একটি জায়গা কেমন অস্থির হয়ে আছে। চাপা, দমবন্ধ একটা আওয়াজ সর্বক্ষণ। পূর্ব পাকিস্তানে তখন মধ্যরাত। কিন্তু ঘুম নেই কারোর চোখে। আরেকজনও হয়ে উঠেছেন অচঞ্চল। খবর পেয়েছেন তাঁকে গ্রেফতার করা হবে। পাকিস্তানের সেনা শিগগিরই চলে আসবে বাড়িতে। আর দেরি করা যাবে না। একটি কাগজে তৈরি করেন খসড়া। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। শেখ মুজিবুর রহমান স্বাক্ষর করলেন সেই ঘোষণায়—
“এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সেনাটিকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক।”
কয়েকদিন পেছনে ফেরা যাক। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করে। গোটা পূর্ব পাকিস্তান আশায় থাকে, এবার বোধহয় স্বাধীনতা আসবে। আর আশা কেনই বা দেখবেন না তাঁরা। স্বয়ং বঙ্গবন্ধু যে এবার পাকিস্তান সরকারের মঞ্চে। কিন্তু পরিস্থিতি মানতে পারলেন না পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এই অবস্থাকে ‘রাজনৈতিক সংকট’ বলে উল্লেখ করেন। প্রতিবাদে গর্জে ওঠে বাংলা। অনেক হয়েছে; আর নয়। এবার কিছু একটা হওয়া দরকার। শেখ মুজিবুরও তাই চান। প্রতিবাদে গিয়ে ঢাকা রক্তে ভাসল। অবশেষে এল ৭ মার্চ। গোটা জাতির চোখ রেসকোর্স ময়দান। মঞ্চে শেখ মুজিবের দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষিত হল ‘স্বাধীনতার বার্তা’। “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
বাঙালির রক্তে যেন ঢুকে গিয়েছিল সেই আহ্বান। দিকে দিকে সেই সংগ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন মানুষরা। উল্টোদিকে যেন সুযোগের অপেক্ষায় ছিল পাকিস্তানি সেনারা। ২৫ মার্চ, তখন রাত হয়ে গেছে বেশ। হঠাৎই শুরু হল হামলা। ঢাকা-সহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নানা জায়গায় আক্রমণ চালায় সেনা, হানাদার। শুরু হয় ‘অপারেশন সার্চলাইট’। মূল উদ্দেশ্য ছিল যেন-তেন-প্রকারেণ এই বিপুল আন্দোলনকে দমন করা। গুলি, বোমা, বেয়নেট— মানুষ মারার আয়োজন করাই ছিল। একজন দুইজন নয়, শয়ে শয়ে মানুষকে স্রেফ চোখের পলকে হত্যা করা হয়। নারীদের ওপর নেমে আসে অত্যাচার। ঠিক করা হয় গ্রেফতার করা হবে শেখ মুজিবুর রহমানকে। সেটা আন্দাজও করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তারপর, স্বাধীনতার সেই ঘোষণাপত্র…
২৬ মার্চ সকালে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি সর্বত্র ছড়িয়ে দেন চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের কর্মকর্তা বেলাল মহম্মদ, আবুল কাসেম এবং আরও বিশিষ্টজনরা। পরের দিন, ২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমানও স্বাধীনতার সংগ্রামের কথা ঘোষণা করেন বেতারে। সেই সময় থেকেই মাঠে নেমে পড়া সবার। এই রক্ত যে বৃথা যাবে না! এই বলিদানের ভেতর থেকেই স্বাধীনতার মন্ত্র উঠে আসবে; উড়বে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। বাংলার ভাই-বোনেদের রক্ত কিছুতেই বিফলে যেতে পারে না। পরবর্তী নয় মাস বিশ্ব সাক্ষী থাকে মুক্তিযুদ্ধের। সমস্ত মানুষের রক্তে আগুন। মাঠে ঘাটে পড়ে আছে দেহ; অকথ্য অত্যাচার নেমে আসছে মেয়েদের ওপর। যত আসছে, ততই গর্জে উঠছে সবাই। যার ফল, সবুজ মাঠের ওপর এক রক্তিম সূর্যের উড়ান! স্বাধীন হল বাংলাদেশ।
Powered by Froala Editor