সময়টা ২০০৩ সাল। গুজরাটের রাইওলি গ্রামের এক রাঁধুনির রান্না হঠাৎ সারা রাজ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কাছেই রয়েছে প্রাগৈতিহাসিক প্রত্নক্ষেত্র বালাসিনোর। সেখানে সারা বছর পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। নানা দেশের সেইসব পর্যটকদের কাছেও এই খাবারের কথা পৌঁছে যায়। অথচ তিনি আলাদা কোনো মশলাই ব্যবহার করেন না। এই রহস্য নিয়ে খবর ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। এর মধ্যেই বালাসিনোর অঞ্চলের প্রাচীন রাজপরিবারের সদস্যা আলিয়া সুলতানা বাবি একদিন আবিষ্কার করে ফেললেন সেই রহস্য। সেই রান্নাঘরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। আড়াল থেকে দেখলেন, যে শিল-নুড়িতে মশলা বাটছেন মহিলা তা একেবারেই বাজারের প্রচলিত শিল-নুড়ির মতো নয়। গোল নুড়িটা দেখেই তাঁর সন্দেহ হয়। তারপর অনেক তর্কবিতর্কের পর শেষে রাজবাড়ি থেকে একটি বিকল্প নুড়ি রাঁধুনির হাতে তুলে দিয়ে সেটি সঙ্গে নিয়ে আসেন।
কিছুদিন পরেই আলিয়া জানালেন, তাঁর সন্দেহই সঠিক। নুড়িটি আদৌ কোনো স্বাভাবিক পাথর নয়। সেটি আসলে একটি জীবাশ্ম। প্রায় ৬৫ মিলিয়ন বছরের পুরনো একটি ডাইনোসরের ডিম। অবশ্য এতে অবাক হওয়ার তেমন কিছু নেই। কারণ গুজরাটের এই অঞ্চলটি এর আগেই অবাক করেছে বিজ্ঞানীদের। গোটা বালাসিনোর এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য জীবাশ্ম। কোথাও কোথাও রয়েছে ডাইনোসরের ডিমও। আর একদম বালাসিনোর শহরের মাঝেই রয়েছে একটি বিরাট অঞ্চল, যা ডাইনোসরদের ডিম পাড়ার জায়গা ছিল বলেই মনে করছেন জীবাশ্মবিজ্ঞানীরা। আমেদাবাদ শহর থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বালাসিনোর শহর। অথচ এই ২০ কিলোমিটারের যাত্রায় যেন প্রায় ১০ কোটি বছর পিছিয়ে যেতে হয়।
১৯৮১ সালে বালাসিনোর শহরে শিলা পরীক্ষার জন্য হাজির হয়েছিল জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার একটি দল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল শহরে শিলার গঠন এবং লাভার আস্তরণ পরীক্ষা করা। কিন্তু সামান্য কিছু খননকার্য চালাতেই অবাক হলেন তাঁরা। পাথরের মাঝে জমে থাকা জিনিসগুলো আসলে কী, তা স্পষ্ট করে বোঝা যাচ্ছিল না। তবে তা যে কোনো প্রাণীর জীবাশ্ম, তাতে সন্দেহ নেই। সঙ্গে সঙ্গে জীবাশ্মবিজ্ঞানীদের খবর দেওয়া হয়। প্রায় ৪ বছর ধরে পরীক্ষা চলার পর অবশেষে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হলেন, এই জীবাশ্ম আসলে ডাইনোসরের। অবাক হয়েছিলেন সবাই। কারণ ভারতে ডাইনোসরের বসতি ছিল বলে আগে জানা যায়নি। কিন্তু প্রমাণ তো হাতের কাছেই রয়েছে।
এই ঘটনার সময় আলিয়া ইউরোপে ছিলেন পড়াশোনার জন্য। সেখানে বসেই এই আবিষ্কারের খবর পেয়েছিলেন। ১৯৯৫ সালে তিনি যখন দেশে ফিরে আসেন, তখন এই জীবাশ্মগুলোই তাঁকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করছিল। ততদিনে মুক্তি পেয়ে গিয়েছে বিখ্যাত সিনেমা জুরাসিক পার্ক। সেই সিনেমার কাহিনিও চোখের সামনে ভাসছিল আলিয়ার। তিনিই এই এলাকাটির নাম রেখেছিলেন ‘জুরাসিক পার্ক অফ ইন্ডিয়া’। এরই মধ্যে ২০০০ সাল নাগাদ জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার সঙ্গে গবেষণার জন্য আসে আমেরিকার বিজ্ঞানীদের একটি দল। তাঁদের সমস্ত জায়গা ঘুরিয়ে দেখানোর দায়িত্বও পড়ে আলিয়ার উপর। তবে আলিয়া শুধুই পথপ্রদর্শক হয়ে থাকেননি। সেইসঙ্গে তিনি নিজেও একটু একটু করে ডাইনোসর চেনার পদ্ধতিগুলো শিখতে শুরু করেছিলেন। আর তাই ২০০৩ সালে সেই ডিমটিকে দেখে চিনতে পেরেছিলেন।
মনে করা হয়, প্রায় ১৪৪ মিলিয়ন বছর আগে এই অঞ্চলে ডাইনোসরের বসতি শুরু হয়। তখন অবশ্য জায়গাটা আফ্রিকার ভূখণ্ডের সঙ্গেই যুক্ত ছিল। টেরানোসোরাসের সম্পর্কীয় কিছু প্রজাতি বাস করত এখানে। পৃথিবীর মানচিত্র বদলাতে থাকে। আফ্রিকার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়। তবে ডাইনোসরের বিবর্তন থমকে থাকেনি। এই বালাসিনোর শহরেই পাওয়া গিয়েছে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম ডাইনোসরের হদিশ। যার নাম রাজাসোরাস। আর এই প্রজাতিটির সবচেয়ে অবাক করা বৈশিষ্ট্য, তার মাথার উপর রয়েছে একটি ছোট শিং। যেটাকে মুকুট বলেও কল্পনা করা যায়। আর এই মুকুটের কারণেই তাকে রাজা বলা হয়। রাজা থেকেই রাজাসোরাস।
আলিয়ার উদ্যোগে বালাসিনোর শহরে ৭২ হেক্টর জমি নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি ফসিল পার্ক। সেখানে কাঁটাতারের বেড়ার মধ্যে জীবাশ্ম সংরক্ষণের পাশাপাশি রয়েছে বেশ কিছু ডাইনোসরের মডেলও। প্রতিটাই তাদের প্রকৃত আকারের সমান। আজও জিওলজিক্যাল সার্ভের গবেষকরা পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি এই সংগ্রহশালা দেখতেও আসেন অনেকে। খুদে স্কুল পড়ুয়াদের জন্য আছে জিওলজিক্যাল সার্ভের বিশেষ ব্যবস্থা। তারা আরও ভালোভাবে এই ইতিহাসকে জানুক, এমনটাই চান গবেষকরা। আলিয়া সুলতানা বাবিও কাজ করে যাচ্ছেন নিজের মতো করে। তাঁর উদ্দেশ্য অবশ্য এই প্রত্নক্ষেত্রটির সংরক্ষণের বিষয়ে মানুষকে উৎসাহিত করা। আশেপাশের গ্রামে গিয়ে গিয়ে মানুষকে বোঝাচ্ছেন জীবাশ্মগুলির গুরুত্ব। এখনও অবধি ১৩টি ডাইনোসরের প্রজাতি পাওয়া গিয়েছে বালাসিনোর ও তার আশেপাশের অঞ্চলে। এর মধ্যে রাজাসোরাস এবং অন্য একটি প্রজাতি সম্পূর্ণ নতুন। পৃথিবীর আর কোথাও তাদের সন্ধান পাওয়া যায়নি। হয়তো আগামীদিনে আরও রহস্যময় কোনো প্রজাতির সন্ধান পাওয়া যাবে ভারতের এই জুরাসিক পার্কে।
Powered by Froala Editor