শ্বাস বন্ধ করে একটি বাথটাবে মাথা চুবিয়ে দিলেই আপনি দেখতে পাবেন, স্থির হয়ে আসছে হৃদস্পন্দন। লো অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের কারণেই সঙ্কুচিত হয়ে যাবে ধমনী। শক্তি সঞ্চয়ের স্বাভাবিক প্রতিবর্ত ক্রিয়া এটি। একজন সাধারণ মানুষ কয়েক সেকেন্ড থাকতে পারেন জলে ডুবে, কেউ কেউ এক মিনিট পর্যন্ত। কিন্তু এবার যাদের কথা বলব, তারা এক বুক শ্বাস নিয়ে সমুদ্রের জলে ২০০ ফুটের গভীরতা পর্যন্ত ঘুরে আসতে পারে পারে টানা ১৩ মিনিট দম বন্ধ রাখতে। তাঁদের নাম ‘সামা বাজাউ’।
এই যাযাবর উপজাতির দেখা মেলে ফিলিপিন্স, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার বাইরের জলভাগে। মূলত মালয় সমুদ্রে। কোনও নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই এদের। ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝের কিছু উপসাগরের নীল জলে বসবাস। কখনও ব্রুনেই, কখনও থাইল্যান্ড কখনও অন্য দেশের গায়ে। এক বিশেষ আকৃতির নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়ায় তারা। সি জিপসিদের এই নৌকাগুলির নাম লেপা-লেপা। স্থলভাগ থেকে কিলোমিটার খানেকের দূরত্বে বাঁশ আর কাঠ দিয়ে বানিয়ে নেয় অস্থায়ী ঘরবাড়ি। এই ঘরবাড়ি কয়েকঘণ্টার মধ্যে খুলে ফেলা যায়। বাড়ি থেকে বাড়ি যাতায়াতের একমাত্র রাস্তা লেপা-লেপা। বাড়িগুলি অস্থায়ী হলেও এতই মজবুত যে, সুনামিতে কোনওরকম ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বাজাউদের। জীবিকা বলতে ডুব দিয়ে মাছ, অক্টোপাস ইত্যাদি শিকার আর ঝিনুক জাতীয় জিনিস খুঁজে আনা, যা দিয়ে কিছু বানানো সম্ভব।
কাগজে-কলমে কোনও দেশ নেই এদের, তারিখ বা সময় সম্পর্কে ধারণাই নেই কোনও। পাড়ের কাছাকাছি দু’একটি গ্রামের দৌলতে জোটে জল, জ্বালানি ও জামাকাপড়। এছাড়া পাড়ে ওঠার কোনও অনুমতি থাকে না সারাবছর।
এই উপজাতি সম্পর্কে প্রচলিত আছে একটি মিথ। প্রায় হাজার বছর আগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জোহর রাজের রাজকন্যাকে সুলু রাজ্যের রাজার সঙ্গে বিয়ে দিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল জলপথে। জোহরের রাজার রাজকীয় নৌবহরে রাজকন্যাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল এই বাজাউ উপজাতি। উপকূলবর্তী অঞ্চলে থাকার কারণে এরা সমুদ্রকে চেনে নিজেদের হাতের তালুর মতো। এই নৌবহরে আচমকা হামলা করেন ব্রুনেইয়ের তৎকালীন সুলতান, যাঁর নজর ছিল রাজকন্যার প্রতি। সুলতান রাজকন্যাকে ছিনিয়ে নিয়ে যান ব্রুনেইয়েই। এর ফলে বিপদে পড়ে বাজাউরা। মৃত্যুভয়ে ফিরে যেতে পারেনি রাজার কাছে। অতএব ডাঙা থেকে চিরকালের মতোই যোগাযোগছিন্ন হয়ে পড়ে তারা। স্থায়ী বসবাস শুরু হয় জলে।
বাজাউ শিশুরা মাঠের বদলে জলে খেলতে নামে। নারী পুরুষ নির্বিশেষে তারা অত্যন্ত উচ্চমানের ডুবুরি। এমনকি শিশুরাও সাঁতারে অসামান্য দক্ষ। মাছও ধরে নির্দ্বিধায়। এরচেয়েও অবাক করা দুটি ঘটনা জেনে নেওয়া যাক। কাঠ ও ভাঙা কাচের টুকরো দিয়ে তারা খুব প্রিমিটিভ মানের একটি চশমা তৈরি করে। যে চশমা জলের নীচে দেখতে ও জলের চাপ থেকে চোখ বাঁচাতে কাজে লাগে ভীষণভাবে। তীর ছোঁড়ার মতো একটি বন্দুক গোছের যন্ত্রও বানায় তারা কাঠ দিয়েই। এটি মাছ ধরতে ভীষণ উপযোগী।
সমীক্ষা বলে, দীর্ঘদিনের অভিযোজনে এদের ডিএনএ মিউটেশনে প্লীহাটি(স্প্লিন) আকারে অনেক বড় এবং জলের নীচে দীর্ঘ সময় থাকতে এটি সহায়তা করে। হাজার বছরের জলে বসবাস তাদের। জীবনের অধিকাংশটাই নৌকায় এবং জলে ভাসমান বাড়িতে। বাড়িগুলিও গভীর সমুদ্রে। যেখানে তরঙ্গ নেই বললেই চলে। বয়সের কোনও ধারণা এদের নেই। অনেকেই জীবনে একবারের জন্যও পা রাখেনি মাটিতে। গোটা জীবন নৌকায় কাটিয়ে দিয়েছে হাসিমুখে। ভূখণ্ডের প্রতিরূপ উপজাতির তুলনায় অনেকাংশেই অবহেলিত সামা বাজাউ-রা। কেবল ধরা মাছের বিনিময়ে নিয়ে যায় পানীয় জল ও আগুন জ্বালাবার জ্বালানি।
এখানেও গল্পটা খুব সুখের নয়। অত্যধিকভাবে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে মাছ ধরা বৃদ্ধি পাওয়ায় মাছ কমে এসেছে স্থানীয় জায়গাগুলিতে। সামুদ্রিক খাবার ছাড়া আর কোনওই খাদ্যের উৎস নেই তাদের। এমনকি আগুন জ্বালাতেও অধিকাংশ সময় প্রয়োজন হয় মাছের তেলের। এই অভাব তাদের ভাবাচ্ছে জীবনযাপন নিয়ে। ফলত অনেকগুলি পরিবারই বসবাস ছেড়ে চলে যাচ্ছে অন্যত্র।