চলতি বছরের শুরুর দিকে র্যা প গায়ক বাদশার ‘গেন্দা ফুল’ গান নিয়ে তৈরি হয়েছিল বিতর্ক। প্রথমত, সেই গানে গানটির রচয়িতা রতন কাহারকে যথাযথ স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ ওঠে। তার সঙ্গেই আদতে গানটিকে যথেষ্ট বিকৃত করে গাওয়া হয়েছে বলেও ফুঁসে ওঠে শিল্পীমহল। গানটিতে নায়িকার চটুল উত্তেজক অঙ্গভঙ্গি নিয়ে অভিযোগ ওঠার সঙ্গেই যেভাবে গানটির অংশ হিসেবে রতন কাহারের ‘বড়লোকের বিটি লো’ গানটিকে ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে যথার্থ অর্থেই সেটিকে পণ্যায়ন অভিহিত করা হয়েছিল। বিতর্কের সামনে পড়ে গায়ক বাদশা স্বীকার করে নেন যে, রতন কাহারকে স্বীকৃতি না দেওয়া ভুল হয়েছিল। পরবর্তীতে রচয়িতা রতন কাহারকে যথাযোগ্য সম্মানও তিনি পৌঁছে দিয়েছিলেন।
করোনা ভাইরাস আবহে দেশজোড়া লকডাউনের বাজারে এই বিতর্ক ভুলে গিয়েছিল সকলেই। কিন্তু পুঁজিবাদী অর্থনীতির একটি বড়ো দিক হল, লাভ অথবা ‘প্রফিট’-এর দিকটিকে কখনোই ছেড়ে না দেওয়া। সুতরাং বিতর্কিত সেই ‘গেন্দা ফুল’ ফিরে এল আবার। এবং, যে বাংলাকে অসম্মান করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছিল, ফিরে এল সেই বাংলার প্রথিতযশা শিল্পীদের হাত ধরেই।
বর্তমান বাংলা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম জনপ্রিয় পরিচালক অরিন্দম শীলের পরিচালনায় বাদশার গাওয়া ‘গেন্দা ফুল’-এর ‘তবলা বিট রিমিক্স’ করলেন স্বনামখ্যাত তবলা বাদক বিক্রম ঘোষ। শুধু তাই নয়, চমক হিসেবে এই গানে অভিনয় করলেন রতন কাহার নিজেও। গান গাইলেন। পাল্লা দিয়ে নাচলেন ভিডিয়োতে অভিনেত্রী দেবলীনার সঙ্গেও। এবং প্রশ্ন উঠে গেল, যেখানে আগের ভিডিয়োটিকে ‘চটুল’ বলে বিতর্ক উঠেছিল, এবার এই ভিডিয়োতে কিন্তু তার অন্যথা হতে দেখা গেল না! তবুও বিতর্কের বদলে এবার যেন ধন্য ধন্যই করা হচ্ছে গানটিকে নিয়ে। ইউটিউবে রিলিজ করার দু'দিনের মধ্যেই ২৭ লক্ষেরও বেশি মানুষ ভিডিয়োটি দেখে ফেলেছেন সেখানে। এবং আশ্চর্যজনক ভাবে দেখা যাচ্ছে যে, এখনও সেখানে কিন্তু গানটির কথা অথবা ‘লিরিক্স’-এর জায়গায় দেওয়া আছে বাদশার নাম! গানটির বর্ধিত বাংলা অংশটি লিখেছেন সুগত গুহ। রতন কাহারকে দেখানো হয়েছে শুধুমাত্র অভিনেতা হিসেবেই। গানটির বিস্তারিত অংশে এটিকে র্যা পার বাদশা এবং তবলা বাদক বিক্রম ঘোষের ফিউশন হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
তবুও এবারে এই গানটিকে নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠল না কেন? বলিউড অভিনেত্রীর সঙ্গেই যে বাঙালি অভিনেত্রীকে দেখা গিয়েছে এখানে, যেভাবে পরিচালনা করা হয়েছে তার সমস্ত অঙ্গভঙ্গি, তাতে সেটিকেও যথেষ্ট ‘চটুল’ বলাই যায়। তাছাড়াও, যতই এদিকে ‘ফোক ফিউশন’ বলা হোক না কেন, তাতে কিছুতেই ‘লোকগান’ হিসেবে প্রমাণ করা যায় না এটিকে। বরং এক্ষেত্রে যেন এক প্রকার জেনে-বুঝেই কলার উঁচিয়ে লোকগানটির শরীর পুনরায় বিকৃত করা হল। তা কতটা সুখশ্রাব্য হয়েছে সেই ব্যাপারে বিতর্ক থাকতেই পারে; কিন্তু স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাকে ব্যবহার করেও তাঁকে এবারও যেভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হল না, তাতে প্রশ্ন ওঠে অন্য কিছু জায়গায়। প্রমাণ হয় ধনতন্ত্রের সেই পেশিবহুল চেহারাটাই আসলে সত্যি, যেখানে গায়ের জোরে নিজের যা খুশি করে নিতে পারে সে। বিতর্ক উঠলে সেটাকেই সত্যি বলে প্রমাণ করে দেয় শুধুমাত্র অর্থের জোরে। যে সৃষ্টিকর্তা এর আগে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন তাঁকে না জানিয়ে বা স্বীকৃতি না দিয়ে এই গানটি ব্যবহার করা হয়েছে বলে, এবার তাঁকে সামনে রেখেই নির্দ্বিধায় উপেক্ষা করা হয়ে যায় তাঁকে। এবং এভাবেই ধণতন্ত্র দেখিয়ে দেয় যে, সব কিছুকেই কিনে নিয়ে পয়সার জোরে বন্ধ করে রাখা যায় মুখ।
উঠে আসছে আরও কয়েকটি প্রসঙ্গ। অত্যন্ত গুণী শিল্পী হয়েও এই বার্ধক্যে পৌঁছে প্রবল অর্থকষ্টে ভুগছিলেন রতন কাহার। অথচ তখন বাংলার শিল্পমহল খোঁজ রাখেনি সেই দুর্দশার। তাই যুক্তি উঠতেই পারে যে, যদি পেটের টানে রতন কাহার রাজি হয়ে থাকেন নিজেকে এভাবে সামনে আনতে, তাতে ক্ষতি কী হল? কারণ যারা সমালোচনা করছেন, তারা তো দায়িত্ব নেননি পেট ভরানোর! সুতরাং যতই উৎসবের রোশনাইয়ে ঝলমল করুক চারিদিক, তার পিছনেই জমাট বাঁধা অন্ধকার কিন্তু একটা আছেই।
তবুও, আরও অন্য কিছু কি করা যেত না গানটিকে নিয়ে? এভাবে বাদশার গানটির সঙ্গেই ‘এডিট’ করে নতুন অংশটি ব্যবহার করতে হল নতুন বোতলে পুরনো মদের মতো? আরও বেশি একটু স্বীকৃতি কি দেওয়া যেত না রতন কাহারকে? কেন এবার বন্ধ হয়েই রইল প্রতিবাদের সমস্ত মুখ?
আরও পড়ুন
পাবজি-ফৌজি চর্চা, রবীন্দ্রনাথ ও কিছু 'হযবরল'
সুতরাং মুখ বন্ধ করে রাখার পিছনে যে পরিচিত মুখগুলো লুকিয়ে থাকে, যাদের আশার আলো নিয়ে আসার কথা ছিল আসলে, সেখানেও যেন বড়ো বেশি অমাবস্যার অন্ধকার বলে মনে হয়। বাংলার লোকশিল্পকে ঘিরে এই পণ্যায়ন অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের। এরকমই যদি চলতে থাকে, তবে রতন কাহারেরা যে কোনোদিনই সত্যিকারের স্বীকৃতি পাবেন না, তা বলাই যায়।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
১৮ থেকে বেড়ে ২১, বিবাহের আইনি বয়স বাড়িয়েও কি রোখা যাবে প্রসবকালীন মৃত্যু?