বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নেমেছে মফঃস্বলে। কোথাও জ্বলে উঠছে হ্যারিকেন, কোথাও আবার মৃদু সোডিয়াম ভেপার। এই ভরা সন্ধেতেই আড্ডা জমে উঠেছে উকিলবাবুর বাড়ির লম্বা বারান্দায়। আলোচনায় বার বার ঘুরে-ফিরে আসছে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মোহামেডানের নাম। সামিল হয়েছেন, পাড়ার ক্রীড়াপ্রেমী বহু মানুষ। অবশ্য যাঁর বাড়িতে আড্ডা, সে-বাড়ির তরুণ-তুর্কিদের এই আড্ডায় অংশ নেওয়ার জো নেই। তা সত্ত্বেও একপ্রকার আড়ি পেতেই এই ফুটবলের আসরে অংশ নিতেন বছর দশ-বারোর এক কিশোর। লুকিয়ে লুকিয়ে শুনতেন ময়দানের গল্প।
যাঁর কথা হচ্ছে, তিনি আর কেউ নন ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম তারকা সমর, ওরফে ‘বদ্রু’ বন্দ্যোপাধ্যায় (Samar Badru Bandyopadhyay)। তাঁকে আধুনিক ভারতীয় ফুটবলের সর্বকালীন সেরা স্ট্রাইকার বললেও ভুল হয় না এতটুকু। বেশ কিছুদিন ধরেই অ্যালজাইমার, অ্যাজোটেমিয়া, উচ্চ রক্তচাপ-সহ বার্ধক্যজনিত অসুখে ভুগছিলেন কিংবদন্তি ফুটবলার। সপ্তাহ তিনেক আগে শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাঁকে ভর্তি করা হয়েছিল হাসপাতালে। অবশেষে ইতি পড়ল সেই লড়াই-এ। ৯২ বছর বয়সে ময়দান ছাড়লেন ‘বদ্রু’ বন্দ্যোপাধ্যায়।
শুধু ক্লাব ফুটবলই নয়, আন্তর্জাতিক ফুটবলেও রীতিমতো দাপিয়ে বেড়িয়েছেন কোচ রহিম সাহেবের প্রিয় ছাত্র। তাঁর নেতৃত্বেই ১৯৫৬-র অলিম্পিকে সেরা সাফল্য ছিনিয়ে এনেছিল ভারত। চতুর্থ স্থান দখল করে নজর কেড়েছিল গোটা বিশ্বের। অথচ, বাড়িতে ফুটবলের চর্চা থাকলেও, এমন এক কিংবদন্তিকেই ফুটবল মাঠে নামা থেকে প্রায় আগলে রেখেছিলেন তাঁর আইনজীবী বাবা।
১৯২৯ সাল সেটা। তখনও জন্ম নেননি বদ্রু। মাত্র ১৫ দিন হয়েছে বিবাহ হয়েছে তাঁর দাদার। একপ্রকার হই হই করেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন তিনি। গন্তব্য, বালিতে আয়োজিত ফুটবল টুর্নামেন্ট। তবে দিনের শেষে ট্রফি এল না বাড়িতে, এল না মেডেলও। বরং, এসেছিল সাদা কাপড়ে মোড়া দেহ। হ্যাঁ, ফুটবল খেলতে গিয়েই প্রাণ হারিয়েছিলেন তাঁর দাদা। সেই ঘটনা থেকেই ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা থাকলেও একরকম আতঙ্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল বালির বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারে।
আরও পড়ুন
৬০ বছর আগে ফিরিয়েছিলেন আমন্ত্রণ, চুণীর মৃত্যুতে শ্রদ্ধা জানাল ইংল্যান্ডের সেই ক্লাবই
অবশ্য বাবার আপত্তি, বকা-ঝকা— এসব মাঠ থেকে সরিয়ে রাখতে পারেনি তাঁকে। স্কুল ছুটির পরই বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে ফুটবল পেটাতে মাঠে নেমে পড়তেন কিশোর বদ্রু। রীতিমতো নজরকাড়া পায়ের কাজ ছিল সেই বয়স থেকেই। ফুটবলে তাঁর দখল নজর কেড়েছিল ল্যাংচা মিত্র, নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো খেলোয়াড়ের। বয়সে ছোটো হয়েও, অনায়াসেই বড়োদের ম্যাচে জায়গা পেয়ে যেতেন বদ্রু। বুট পরে খেলার অভ্যাস সেখান থেকেই।
আরও পড়ুন
পেলের সঙ্গেই পেয়েছেন ফিফার সর্বোচ্চ সম্মান, একমাত্র এশীয় ফুটবলার বাংলার পিকে-ই
পেশাদার ফুটবলে জড়িয়ে পড়া ১৯৪৮ সালে। তখন ১৭ বছর বয়স তাঁর। বালি প্রতিভা ক্লাবের চুক্তিতে সই করেন বদ্রু। তখন বালি তৃতীয় ডিভিশনের ম্যাচ খেলে কলকাতার লিগে। প্রথম মরশুমেই নজর কাড়েন তিনি। পরের বছরই নাম লেখান বিএনআর-এ। দ্বিতীয় ডিভিশনে সে-বছর চ্যাম্পিয়ন হয় বিএনআর। নেপথ্যে ছিলেন, স্ট্রাইকার বদ্রুই। এর ঠিক দু’বছর পর ১৯৫২ সালে পা রাখেন মোহনবাগানে। শুরু হয় এক স্বর্ণযুগ…
আরও পড়ুন
ফিরিয়ে দিয়েছেন ব্রিটিশ ক্লাবের ডাক, ফুটবলের পাশাপাশি ক্রিকেটেও তুখোড় ছিলেন চুণী
ছোটো থেকেই যে মোহনবাগান স্বপ্ন ছিল তাঁর, সেই ক্লাবের হয়ে প্রথম মরশুমেই আইএফএ শিল্ডের স্বাদ পান তিনি। পরের বছর ডুরান্ড। ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত সবুজ-মেরুন জার্সিতেই ময়দানে নেমেছেন বদ্রু। মোহামেডান কিংবা অন্য বড়ো দলের অফার পেলেও ক্লাববদল করেননি একবারও। এমনকি ফুটবলের নেশায় ছেড়েছিলেন ডাক্তারি পড়াশোনাও। আরজিকর হাসপাতালে তখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্র তিনি। ডুরান্ড কাপ ও অলিম্পিকে মনোনিবেশ করতে ছেড়েছিলেন পড়াশোনা। তাঁর কথায়, ‘আমার জন্মই হয়েছিল মোহনবাগান হয়ে’। এই সাত বছরের কেরিয়ারেই ইতিহাস তৈরি করেছিলেন বদ্রু। মোহনবাগান তাঁবু ভরিয়ে দিয়েছিলেন ট্রফিতে। ডুরান্ড, কলকাতা ফুটবল লিগ, আইএফএ শিল্ড, এয়ারলাইন্স গোল্ড কাপ কিংবা রোভার্স— ভারতীয় ফুটবলে হেন কোনো ট্রফি নেই, যার অধরা থেকে গেছে বদ্রুর। সমানভাবেই পেয়েছেন সন্তোষ ট্রফির স্বাদও।
তবে দেখতে গেলে তাঁর সবচেয়ে বড়ো সাফল্য ১৯৫৬-র অলিম্পিক। সে-বার ভারতীয় দলের অধিনায়কের ভূমিকায় ছিলেন তিনিই। মেলবোর্নে ভারতীয় দলের কাছে ৪-২ গোলে বশ্যতা স্বীকার করেছিল অজিরাও। তবে হাড্ডাহাড্ডি লড়েও যুগোস্লোভিন টিমের কাছে হার মানতে হয় ভারতকে। সেমিফাইনাল থেকেই ছিটকে যায় ভারতীয় দল। তবে অলিম্পিক-জয়ী সোভিয়েত গোলকিপার নেটোর কথায়, সেই অলিম্পিকের ‘ফাইনেস্ট প্লেয়ার’ ছিলেন বদ্রুই।
তবে সেটাই শেষ অলিম্পিক হয়ে রয়ে যায় তাঁর। ১৯৫৮-তে মোহনবাগানের অধিনায়কত্ব পেলেও, দলে অনিয়মিত হয়ে পড়েন বদ্রু। সরকারি চাকরি পেয়ে স্নানান্তরিত হন শিলিগুড়িতে। তারপরই খেলার দুনিয়া থেকে অবসর। তা নিয়েও সমালোচনাও কম হয়নি সে-সময়। অবশ্য সবুজ-মেরুন শিবির কিংবা ফুটবলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল আজীবন। অবসরের পর বড়িশা ক্লাব এবং বাংলার দলকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তিনি। শুধু ফুটবলার হিসাবেই নয়, কোচ হয়েও সন্তোষ ট্রফি এনেছেন বাংলার ঘরে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে কলকাতা ময়দানের কোনো বড়ো ক্লাবের থেকে কোচিং-এর ডাক আসেনি তাঁর কাছে।
আজ আগস্টের ২০ তারিখ। চলতি মরশুমে ডুরান্ডের প্রথম ম্যাচ খেলতে মোহনবাগান নামছে মোহনবাগান। আর এই দিন সকাল বেলাতেই চিরঘুমের দেশে পাড়ি দিলেন প্রথম ডুরান্ডজয়ী মোহনবাগান দলের অন্যতম সারথি সমর ‘বদ্রু’ বন্দ্যোপাধ্যায়। এও এক অদ্ভুত সমাপতনই বটে…
তথ্যসূত্র :
১. উইকিপিডিয়া, ডুরান্ড কাপ
২. Legends Of Indian Football: Samar Banerjee – Where Is He Now?, Goal.com
৩. Samar (Badru) Banerjee, Exclusive Interview, MBAC TV, Youtube.com
৪. Candid one to one with Badru Banerjee, MBAC TV, Youtube.com
৫. Samar Banerjee: The man who led India to the semi-finals in the 1956 Olympics, Goal.com
Powered by Froala Editor