সেটা ১৯৫৬ সাল। মালয়েশিয়া আয়োজিত হয়েছে সিলেঞ্জার ইন্ট্যাননেশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ। আর ব্যাডমিন্টনের সেই মহারণে অংশ নিয়েছে ভারতও। তবে পেশাদার খেলা হিসাবে দেশের সাধারণ মানুষের কাছে তার জনপ্রিয়তা সামান্যই। ব্যাডমিন্টন তখনও স্রেফ শরীর ‘ফিট’ রাখার খেলা। স্বাধীনতার ঠিক পর পরই অল ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে প্রকাশ নাথ পৌঁছেছিলেন ঠিকই, কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে হয় তাঁকে। আন্তর্জাতিক ব্যাডমিন্টনে ভারতের সাফল্য ওইটুকুই। মালয়েশিয়াতেও যে বেশি দূর এগতে পারবে না ভারত, এমনটাই ধরে নিয়েছিলেন তৎকালীন ক্রীড়াবিদরা। শুরুটাও বেশ নড়বড়ে হয়েছিল ভারতের। কিন্তু গোটা বিশ্বকে চমকে দিয়েই সেবার ট্রফি তুলেছিলেন এক ভারতীয় তরুণ। নন্দু নাটেকর। আন্তর্জাতিক ব্যাডমিন্টনে ভারতের উত্থানের শুরু সেই। বাকিটা ইতিহাস।
গতকাল টোকিও অলিম্পিকে দাপটের সঙ্গে কোর্টে রাজত্ব করলেন পিভি সিন্ধু। প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে নিশ্চিত করে ফেললেন নিজের জায়গা। কিন্তু এই আনন্দের দিনও যেন বিষাদঘন হয়ে উঠল মুহূর্তেই। চলে গেলেন ভারতের ‘ব্যাডমিন্টন গ্রেট’ নন্দু নাটেকর। মাস তিনেকেরও বেশি সময় ধরেই শয্যাশায়ী ছিলেন তিনি। ভুগছিলেন বার্ধক্যজনিত অসুখে। গতকাল পুনেতে নিজের বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ভারতের প্রথম আন্তর্জাতিক খেতাবজয়ী ব্যাডমিন্টন তারকা।
তবে ভারতের ব্যাডমিন্টন ইতিহাসে কিংবদন্তি রচনা করলেও, নন্দু নাটেকরের শুরুটা হয়েছিল টেনিস দিয়ে। এমনকি জুনিয়র ন্যাশনালের ফাইনালেও পৌঁছেছিলেন তিনি দু’বার। ১৯৫২ সালের ফাইনালে কিংবদন্তি টেনিস তারকা রামানাথন কৃষ্ণণের কাছে হারের পরই পথ পরিবর্তন করেন নন্দু নাটেকর। টেনিস ছেড়ে ব্যাডমিন্টনকেই বেছে নেন পেশাদারিত্বের মাধ্যম হিসাবে। আশ্চর্যের বিষয়, মাত্র এক বছরের মধ্যেই জাতীয় স্তরে নিজের জায়গা পাকা করে ফেলেছিলেন তিনি। এমনকি ১৯৫৪ সালে দ্বিতীয় ভারতীয় হিসাবে পৌঁছে গিয়েছিলেন ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়নশিপের কোয়ার্টার ফাইনালে। আর তার ঠিক দু’বছরের মাথায় মালয়েশিয়ার কোয়ালালাম্পুরে ভারতের হয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক ট্রফি।
তারপর থেকে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে থমাস কাপে ভারতীয় দলের নেতৃত্ব ছিল তাঁর কাঁধে। ভারত প্রথম কিংস কাপ জেতাও তাঁর হাত ধরেই। ১৯৬৬ সালের কমনওয়েলথ গেমসেও ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন নন্দু নাটেকর। তৎকালীন সময়ে ৬ বার জাতীয় ডবলস এবং সিঙ্গলস চ্যাম্পিয়নশিপ পকেটস্থ করে রেকর্ড তৈরি করেছিলেন তিনি। ছিলেন ৫ বারের মিক্সড ডবলস চ্যাম্পিয়ন। ১৫ বছরের ব্যাডমিন্টন কেরিয়ারে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খেতাব মিলিয়ে তাঁর সংগ্রহে রয়েছে ১০০টি ট্রফি। দেশের প্রথম অর্জুন পুরস্কারপ্রাপ্ত খেলোয়াড় তিনিই।
আরও পড়ুন
‘হ্যাঁ, আমি সমকামী’, অলিম্পিকে সোনা জিতে গর্বিত উচ্চারণ টমের
তবে ট্রফি কিংবা পুরস্কার দিয়ে তাঁর কৃতিত্ব বিচার করা খানিকটা বোকামোই। সাফল্যের থেকেও আন্তর্জাতিক ব্যাডমিন্টনজগতে তাঁর পরিচিতি ছিল ম্যাজিকাল স্কিলের জন্য। ব্যাকহ্যান্ড স্ট্রোকে তাঁর পারদর্শিতা মুগ্ধ করে রাখত দর্শকদের। সে কারণে আন্তর্জাতিক একাধিক সংবাদ মাধ্যমের থেকে ‘টাচ আর্টিস্ট’ খেতাবও পেয়েছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন
বাংলা-সহ ৩০টি ভাষায় ইমোজি প্রকাশ অলিম্পিক কমিটির
তবে ব্যাডমিন্টন তাঁর ধ্যান-জ্ঞান হলেও, সমানভাবেই ক্রিকেট ও টেনিসের প্রতি আগ্রহ ছিল তাঁর। অবসরের পর ব্যাডমিন্টন-এর কোচিং করানোর পাশাপাশি, নিয়মিত তিনি হাজির হতেন গলফ কোর্সে। এমনকি তাঁর সন্তান তথা টেনিসে ৭ বারের ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন গৌরব নাটেকরের প্রথম টেনিস কোচের ভূমিকাও পালন করেছিলেন তিনি। সেখানে দাঁড়িয়ে বহুমুখী প্রতিভা বললেও বোধ হয় কম বলা হয় তাঁর সম্পর্কে। এমন এক ‘অভিভাবক’-এর প্রয়াণে শোকস্তব্ধ ভারতের ক্রীড়ামহল। ভারত তো বটেই, পৃথিবীর তৃতীয় প্রবীণতম ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড়ের মৃত্যুতে ইতি পড়ল আন্তর্জাতিক ক্রীড়াক্ষেত্রের এক দীর্ঘ অধ্যায়ে…
আরও পড়ুন
অলিম্পিকের আগেই কুস্তির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ৮টি সোনা ভারতের
Powered by Froala Editor