ভারত আর চিনের মধ্যে সংঘর্ষ নতুন কিছু নয়। ১৯৬২, ১৯৬৭, ১৯৭৫— বারবার উত্তপ্ত হয়েছে সীমান্ত। শান্ত পার্বত্য এলাকা ভারী হয়েছে বুটের আওয়াজে। বহু সংগ্রাম, ইতিহাস, তৈরি হয়েছে এই সময়। তার কিছু হয়ত আমাদের জানা, কিছু হয়ত বরফের আড়ালেই চাপা পড়ে গেছে। কিছু কাহিনি আবার সেনাবাহিনী ও ভারতের যুদ্ধ ইতিহাসে মিথের পর্যায়ে চলে গেছে। এভাবেই স্মরণীয় হয়ে আছে ভারত আর চিনের যুদ্ধ পরম্পরা…
নাথুলার দিকে যদি যাওয়া হয়, তাহলে পথেই একটা জায়গায় অন্তত একবার একটু থামতেই হবে। নাথুলা আর জেলেপ লা’র মাঝখানের এই বিশেষ জায়গায় রয়েছে একটি মন্দির। শুধু পার্বত্য এলাকাতেই নয়; ভারতীয় সেনাদের সঙ্গে ভারতের অন্যান্য জায়গাতেও এই মন্দির বিশেষ দ্রষ্টব্য। কারণ এখানকার ভগবান স্বয়ং বাবা হরভজন সিং! ভারতের অন্যান্য জায়গা তো বটেই, পৃথিবীর আর কোথাও একজন সেনার স্মরণে ধর্মস্থান তৈরি হয়েছে কি? তবে বাবা হরভজন সিং আর তাঁর এই মন্দির কেবল স্মরণ করার জন্য নয়; তার থেকেও বেশি কিছু…
বাস্তবে হরভজন সিং ছিলেন ভারতীয় সেনার একজন সাধারণ সৈন্য। পাঞ্জাব রেজিমেন্টে যুক্ত হবার পর ১৯৬৮ সালে কাজের সূত্রে চলে আসেন নাথুলাতে। দুর্গম জায়গা, প্রবল শীত; তার ওপর একদম কাছেই সীমান্ত এলাকা। কয়েক বছর আগেই এই পুরো এলাকা দেখেছে যুদ্ধের ভয়াবহতা। ভারত আর চিন একে অপরের সম্মুখ সমরে নেমেছিল। ১৯৬৮ সালে সেসব না থাকলেও, পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল না। যখন তখন আক্রমণ আসত, আর তার জন্য তৈরিও ছিল ভারতীয় সেনা।
এরকমই একদিন সেনার রসদ নিয়ে ফিরছিলেন বছর বাইশের হরভজন সিং। কিন্তু মাঝপথেই নিখোঁজ হয়ে যান তিনি। কোথায় যান, কী হয়, যদি মারাও যান তবে মৃতদেহ কোথায় কিচ্ছু জানা যায় না। তন্ন তন্ন করে খোঁজা হলেও ব্যর্থ হতে হয়। আর এরপরেই ঘটে আসল ঘটনা। সেনাদের মধ্যে প্রচলিত আছে সেসব অলৌকিক মুহূর্তের বর্ণনা। মৃত্যুর দিন তিনেক পর ওখানকারই বেশ কিছু সেনার স্বপ্নে আসেন হরভজন সিং। সেখানে এসে নাকি বলে যান ঠিক কোথায় রয়েছে তাঁর দেহ। এবং তাজ্জব ব্যাপার, সেই জায়গায় খোঁজ করা হলে সত্যিই পাওয়া যায় হরভজন সিংয়ের নিথর দেহ! রহস্যের শুরুটা এখান থেকেই শুরু হয়েছিল। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত সেই রহস্য চলে আসছে।
আরও পড়ুন
২৪২ বছর আগে বাংলায় চিনা উপনিবেশ, অধরাই রইল ‘দ্বিতীয় কলকাতা’ তৈরির পরিকল্পনা
মৃত্যু তো দৈহিক ব্যাপার, কাজ তো থেকে যায় মানুষের মধ্যে। কিন্তু হরভজন সিংয়ের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরও অনেক বেশি ‘জীবন্ত’ ছিল। মৃত্যুর পরেও নাকি তিনি সেনাবাহিনী ছাড়তে পারেননি। আজও একইভাবে অদৃশ্য থেকে কাজ করে যাচ্ছেন। এমনকি, মৃত্যুর পরও হরভজন সিংয়ের পদোন্নতি হয়; তিনি উত্তীর্ণ হন ক্যাপ্টেনের পদে। সীমান্তের ওপার থেকে কোনো চিন আক্রমণ হলেও হরভজন সিংই সৈন্যদের আগেভাগে ‘জানিয়ে দিয়ে যান’! এমন সব কাহিনির জন্যই হরভজন সিং হয়ে যান ‘বাবা’। পাহাড়েই তৈরি হয় মন্দির; যেখানে প্রণামী হিসেবে এক বোতল জল রাখা হয়! তাতেই নাকি তিনি সন্তুষ্ট। মৃত হয়েও জীবিত একজন সেনার সমস্ত রকম নিয়ম সম্পন্ন করা হয়েছে। এতটা সম্মান আর কি কেউ পেয়েছেন? অবশ্য শুধু ভারতীয় সেনারাই নন, চিন সেনারাও নাকি বাবা হরভজনকে যথেষ্ট মানেন; ভয়ও পান। তবে তিনি ঠিক কী কারণে মারা গিয়েছিলেন তা আজও অজানা।
আরও পড়ুন
অভিযাত্রী গালওয়ানের নামেই নামকরণ উপত্যকার, নিজেও সাক্ষী ছিলেন চিনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের
ভারত-চিনের যুদ্ধের বেশ পরের ঘটনা এটি। কিন্তু ’৬২-এর যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে এরকমই একজন তরুণ সেনা একা হাতে নিকেশ করেছিলেন চিনা সৈন্যদের। তিনি রাইফেলম্যান যশওয়ান্ত সিং রাওয়াত। ১৯৬২ সালে ভারত-চিন যুদ্ধ শুরু হবার পর উত্তর-পূর্ব সীমান্তের অবস্থা রীতিমতো ভয়ংকর হয়ে ওঠে। বিশেষ করে অরুণাচল প্রদেশের বিস্তীর্ণ জায়গায় নেমে আসে চিনের পিপলস লিবারেশন আর্মি। ’৬২-এর নভেম্বর মাসে এইরকমই একটি বাহিনী আক্রমণ করে নুরানাংয়ে। সেখানে নর্থ-ইস্ট ফ্রন্টিয়ারের চার নম্বর গারওয়াল রাইফেল বাহিনী নিজেদের পজিশন নিয়েছিল। এই বাহিনীরই অন্যতম অংশ ছিলেন যশওয়ান্ত সিং রাওয়াত। তাঁর সঙ্গে আরও দুজন সেনা ছিলেন। কিন্তু উল্টোদিকে কয়েকশো সৈন্য অবিরাম গুলিবর্ষণ করে যাচ্ছে। এমনকি মেশিনগান নিয়েও আক্রমণ শুরু হল।
আরও পড়ুন
দেশজুড়ে যুদ্ধ-পরিস্থিতি, কেমন আছেন ভারতের চিনা মানুষরা?
এমন পরিস্থিতিতে সঙ্গী দুই সেনাও শহিদ হবার পর গুরুতর আহত অবস্থাতেও একা লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন বছর একুশের যশওয়ান্ত। নিজের মৃত্যুর আগে চিনের ওই বিশাল বাহিনীকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন; প্রায় ৩০০ জন চিনা সৈনিক মারা যায়। উল্টোদিকে ভারতীয় সেনাদের মধ্যে মাত্র দুজনের জীবন চলে যায়, বাকিরা আহত হন। শেষে শহিদ হন যশওয়ান্ত সিং রাওয়াতও। ঠিক যেখানে এই ঘটনাটা ঘটে, আজ সেই জায়গাটির নাম ওঁর স্মরণে রাখা হয়েছে ‘যশওয়ান্তগড়’। সেখানে তৈরি হয়েছে একটি মেমোরিয়ালও। পরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পুরস্কার মহাবীর চক্রও (মরণোত্তর) পান যশওয়ান্ত সিং রাওয়াত।
আরও পড়ুন
ভারত-চিন যুদ্ধে, চিনা সৈন্যদের একাই আটকে দিয়েছিলেন ‘রাইফেলম্যান’ যশবন্ত
এভাবেই যুদ্ধের সঙ্গে তৈরি হয়েছে বীরত্বের গাথা। কখনও সেখানেই উঠে এসেছে অলৌকিক সব ঘটনা। আর এসবই স্মৃতি হয়ে উঠে আসছে সবার মনে। সেইসঙ্গে শঙ্কিত হয়ে নজর রাখছেন খবরে। করোনার আবহে যুদ্ধ শুরু হলে ঠিক কী হবে, কূলকিনারা পাচ্ছেন না কেউই।
Powered by Froala Editor