সাল ১৯৫২, দিল্লি। পাঁচ বছর হল ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়েছে। দেশ জুড়ে তখন উৎসবের মেজাজ। সেই উপলক্ষে কন্সটিটিউশন ক্লাবের লনে, একই মঞ্চে সঙ্গীত পরিবেশন করবেন সদ্য তিরিশ ছোঁয়া দুই তরুণ শিল্পী। সেতার হাতে যিনি তার নাম রবিশঙ্কর, সরোদ হাতে আলী আকবর খান। দ্বৈতবাদন আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হল বলে।
দুজনেই বাবা আলাউদ্দিন খান সাহেবের সাকরেদ, সেই আলাউদ্দিন যিনি বিশ্ববিখ্যাত সেনিয়া মাইহার ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের যুগ পুরুষ, অসামান্য শিল্পী ও চড়া মেজাজের জন্য সর্বজনবিদিত ও পরম শ্রদ্ধেয়।
ঝঙ্কার মিউজিক ফেস্টিভ্যালের অংশ এই বিশেষ যুগলবন্দিকে কেন্দ্র করে দিল্লির সঙ্গীতপ্রেমীদের মধ্যে তখন উত্তেজনার পারদ ক্রমেই ঊর্ধ্বগামী। আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের প্রিয়ছাত্র রবিশঙ্কর তখন তার অসাধারণ প্রতিভা ও অল ইন্ডিয়া রেডিওতে অর্কেস্ট্রা নির্মাণ করে গোটা দুনিয়ায় সাড়া ফেলে দিয়েছেন। আলাউদ্দিনের পুত্র, সরোদিয়া আলী আকবর খান তার প্রতিভার গুণে দেশের অন্যতম সেরা ও প্রথমসারির সঙ্গীতশিল্পীদের মধ্যে ততদিনে বানিয়ে নিয়েছেন নিজের স্বতন্ত্র অবস্থান।
সেই সন্ধ্যায় তবলায় দুই শিল্পীকে সঙ্গত করবেন বেনারস ঘরানার প্রবাদপ্রতিম তবলিয়া কণ্ঠে মহারাজ ও তার ভাইপো কিষাণ। পরবর্তী কালে যিনি ভূভারতে তবলাবাদনের পথিকৃৎ কিষাণ মহারাজ নামে প্রসিদ্ধ হবেন।
আরও পড়ুন
‘হিন্দু ললনাদের প্রতিরাত্রে বিয়ে দিচ্ছেন বিসমিল্লা খান’; যাঁর কাছে সুরই হয়ে উঠেছিল ধর্মাচরণ
কন্সটিটিউশন ক্লাবের লনে ফুল দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে স্টেজ। ধপধপে সাদা পোশাকে, দুই শিল্পী এবার ধীরপায়ে উঠে এলেন মঞ্চে। স্মিত হেসে দু-হাত জোড় করে প্রণাম জানালেন উপবিষ্ট অগুনতি দর্শক, সঙ্গীতবোদ্ধা জ্ঞানী-গুণীজনদের। হাততালি দিয়ে উঠল দর্শক। যে মুহূর্তে তাঁরা হাতে তুলে নিলেন তাঁদের যন্ত্র, ঠিক তখনই...
কালো কুর্তা পরা, রিমলেস চশমা চোখে লম্বা, রোগা ছিপছিপে এক যুবক সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর হাতেও রয়েছে সেতার। সরাসরি দর্শকদের মুখোমুখি হয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানিয়ে চোস্ত উর্দুতে বলে উঠলেন - "মঞ্চে কী সুন্দর সব ফুল ফুটে আছে। আমি শুধু তাতে সামান্য সুগন্ধী ছড়াতে চাই। একসঙ্গে একটু বাজাতে চাই রোবু'দা ও আলী'দার সঙ্গে।"
আরও পড়ুন
হেস্টিংসের সঙ্গে কলকাতায় এল পিয়ানো, ভারতচন্দ্রের গানে সুর তুললেন রুশ সাহেব
নিমেষের মধ্যে গুঞ্জন উঠল দর্শকদের মধ্যে। এই দ্বৈতবাদন তো পূর্ব নির্ধারিত। তাহলে এ কে? কীই বা এর পরিচয়? উদ্দেশ্যই বা কী? হঠাৎ করে কেনই বা এভাবে 'বিন বুলায়ে মেহমানে'র মতো উড়ে এসে জুড়ে বসতে চায়? সকলেই অবাক, বিস্ময়ে হতবাক। চুপ করে সেই নাটকীয় মুহূর্ত দেখছেন মঞ্চে উপবিষ্ট দুই শিল্পীও। সমস্ত দর্শকদের নজর তখন তার দিকেই। যেন কোনো অদৃশ্য মন্ত্রবলে সবাইকে বেঁধে ফেলেছে অজ্ঞাতপরিচয় যুবকটি।
যাকে নিয়ে এত প্রশ্ন, তিনি তখনও হাসিমুখে, নম্র চিত্তে দণ্ডায়মান। তার চশমার ফাঁক দিয়ে ঝলসে উঠছে বুদ্ধিদীপ্ত চাহনি, উপচে পড়ছে ব্যাক্তিত্ব। হাতে ধরা সেতারটি যেন ধনুকের মতো কোনো অদৃশ্য শত্রুর উদ্দেশ্যে টানটান। দর্শকদের মধ্যে কেউ কেউ ততক্ষণে চিনে ফেলেছে তাঁকে। তিনি বিলায়েত খান। ইমদাদখানি বা এটাওয়া ঘরানার কিংবদন্তি সেতারবাদক উস্তাদ এনায়েত হুসেইন খান সাহেবের সুপুত্র।
আরও পড়ুন
‘ফাইনালি যখন কাজটা আমিই করছি, আমিই আবহ সঙ্গীত রচনা করি’; সুরের জাদুর সেই শুরু
দর্শকাসন থেকে ছুটে এলেন আলাউদ্দিন স্বয়ং। পুত্রপ্রতিম দুই ছাত্রের যুগলবন্দিকে ত্রয়ীবাদনে পর্যবসিত করতে তিনি নারাজ। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। দর্শকদের সম্মিলিত প্রবল হইহই সম্মতিতে ছাড়পত্র পেয়ে গেছেন যুবক বিলায়েত। সময় নষ্ট না করে নিমেষে লাফিয়ে উঠলেন স্টেজে। অন্য শিল্পীরাও সৌজন্য দেখিয়ে করে দিলেন জায়গা।
স্টেজের সামনে এলেন আলাউদ্দিন। গম্ভীর সুরে বললেন - "মনে রেখো, তোমারা সকলেই আমার সন্তান। এটা কোন প্রতিযোগিতা নয়। ডুয়েল নয়। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সৌজন্য যেন বজায় থাকে।"
সে এক অতুলনীয়, বিরল দৃশ্য। স্টেজের মাঝখানে সরোদ হাতে বসে আলী আকবর, রবিশঙ্কর এবং বিলায়েত দু'ধারে। চওড়া কপালের অতি সপ্রতিভ চেহারার দুই সুপুরুষ, ভবিষ্যতে নিজ নিজগুণে যারা শাসন করবেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ইতিহাস। তাদের দুপাশে তবলা নিয়ে কণ্ঠে এবং কিষাণ মহারাজ, সেই কিষাণ মহারাজ যিনি হাঁটু মুড়ে 'নামাজে' বসার ভঙ্গিতে তবলায় ঝড় তুলতেন। পিছনে পর্বতাকার দুটি বিরাট 'মিরাজ' তানপুরা। সামনে হাই কোয়ালিটির শিকাগো রেডিও মাইক। দর্শকাসনে বাবা আলাউদ্দিন, ফৈয়াজ খান, হাফিজ আলী খান সহ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দুনিয়ার সব প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্বরা বসে। বসে দিল্লির অসংখ্য সঙ্গীতপ্রিয় মানুষ। সঙ্গীত সুধারসে নিমগ্ন হওয়ার এর থেকে ভালো পরিবেশ আর কী হতে পারে।
সৌজন্যপূর্বক অনুমতি চান রবিশঙ্কর। তারপর ধীর হাতে মীড়খণ্ডে দেন মোচড়। রাগ মানঝ খাম্বাজ। সন্ধেবেলার বড় মিষ্টি রাগ। শুরু হয় আলাপ পর্ব। সেই আলাপে মন্ত্রমুগ্ধ তামাম দর্শকেরা। চোখ বুজে যেন ধ্যানে বসেছেন রবি। শান্ত অথচ অভিজ্ঞ আঙুল খুঁজে নিচ্ছে, শুষে নিচ্ছে রস। 'হায় হায়' করে উঠলেন দর্শকেরা। সেতার ধরে চোখ বুঁজে মাথা দোলাচ্ছেন বিলায়েত। কিছুক্ষণ বাজিয়ে তার দিকেই সুরমালিকা ছুঁড়ে দিলেন রবিশঙ্কর। এবার পালা বিলায়েতের।
সঙ্গে সঙ্গে যেন লেলিহান বিদ্যুৎ খেলে গেল মঞ্চে। চমকে উঠলেন আলাউদ্দিন, চমকে উঠলেন সমস্ত দর্শক। এ কোন গ্রহের বাজনা! এমন আলাপ তো আগে শোনা যায়নি। অসাধারণ মুনশিয়ানায় সুরের ঢেউ আছড়ে ফেললেন বিলায়েত। মন্ত্রমুগ্ধ, আপ্লুত দর্শকেরা। বহু সাধনার ফসল এভাবেও পরিবেশন করা যায় সেদিন শিখিয়ে ছিলেন দুই শিল্পী। বাদ যাননি আলী আকবরও। তাঁর সরোদ যে স্বয়ং ঈশ্বরের চারণভূমি, খাম্বাজের স্বর লাগিয়ে তা তিলেতিলে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন আলাউদ্দিন পুত্র।
প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলল আলাপ, বিস্তার। মাঝে হালকা বিলম্বিত গৎ, আওচার, জোড় সেরে ঝালায় উঠে এলেন তিন শিল্পী। যেন স্টেজ জুড়ে শুরু হল ঝড়। সেতারে যখন গমক সহকারে হলকা ও সপাট তান উঠে আসে, তখন তা কেমন অনুভূত হয় সেই দিন হাড়েহাড়ে টের পেয়েছিলেন দিল্লির দর্শকেরা। কিছুক্ষণের মধ্যে পরিষ্কার হয়ে গেল, এ এখন আর সঙ্গীতের নরম, পেলব বিচরণ ভূমি নয়, পুরোদস্তুর যুদ্ধক্ষেত্র। দু'ধারে দুই যোদ্ধা ছুঁড়ে দিচ্ছেন সুরের 'মিসাইল', একে অপরের উদ্দেশ্যে। যেন বহুদিনের দুই অতৃপ্ত প্রতিদ্বন্দ্বী, খুঁজে পেয়েছেন রক্তের স্বাদ। দর্শকেরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
একসময় দেখা গেল সরোদ নামিয়ে রেখেছেন আলী আকবর। ডাইনে বাঁয়ে মাথা ঘুরিয়ে, অবাক চোখে দেখছেন ভারতের দুই সেরা শিল্পীর অদ্ভুত, অলৌকিক সেই লড়াই। কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জায়গা ছাড়তে নারাজ। রবিশঙ্করের হাতে যদি অমৃতের ভাণ্ড উঠে আসে, বিলায়েত তা থেকেই যেন নিংড়ে নেন এক ফোঁটা মহৌষধী। দর্শকেরা ক্রমশ যেন সেই সুরামৃতের সন্ধান পেয়েছেন।
ক্রমশ একটু একটু করে পরিষ্কার হচ্ছে ফলাফল। গোটা সভার মধ্যমণি তখন একজনই। বিলায়েত খান। বাজনার শেষপর্বে রবিশঙ্কর যখন নিমেষে অতিতারা স্পর্শ করে এলেন, বিলায়েত পাল্টায় দেখালেন এক অসম্ভব কাজ। আঙুল নয়, তেল রাখার পিতলের ডিব্বা দিয়ে টান মারলেন তারে। যে আওয়াজ উঠে এল তাতে, তা বুঝি কোনও এক অন্যগ্রহের সুর। সৃষ্টি হল এক অজানা অদ্ভুত অতীন্দ্রিয় শব্দকল্পদ্রুমের। মহাজাগতিক সুরেলা বিস্ফোরণ।
প্রথমসারিতে বসা হাফিজ আলী লাফ দিয়ে উঠে চিৎকার করে বললেন - "মার ডালা! মার ডালা!" উল্লাসে, উন্মাদনায় ফেটে পড়লো গোটা লন। আর লাফিয়ে উঠলেন বাবা আলাউদ্দিন। রাগে ফেটে পড়লেন। হিন্দি নয়, বিশুদ্ধ বাঙাল ভাষায় চেঁচিয়ে উঠলেন - "এইডা শিখাইলাম তগো? আমার নাম ডুবাইলি, শুয়ারের বাচ্চা!" নিমেষে থেমে যায় সব।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে সেদিন বাজি মেরেছিলেন ২৪ বর্ষীয় বিলায়েত খান। হাততালির ঝড় তুলে তাকে অভিবাদন জানান দর্শকেরা, আশীর্বাদ করেন সব গুণীজন। এই ঘটনায় মোটেই খুশি হননি রবিশঙ্কর। এভাবে জনসমক্ষে অপদস্থ হননি কখনো। নীরবে, মাথা নামিয়ে সেতার হাতে বেরিয়ে যান তিনি।
এই ঘটনার কয়েক সপ্তাহ পর তার সৃষ্ট 'বাদ্যবৃন্দ' শোনানোর জন্য রেডিও স্টেশনে বিলায়েত ও আলী আকবর দুজনকেই আমন্ত্রণ জানান রবিশঙ্কর। আলী আকবর তো বটেই, এই 'প্রজেক্টে'র ভূয়সী প্রশংসা করেন বিলায়েত। সর্বকালের তিন সেরা শিল্পী মেতে ওঠেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের এই মেলবন্ধন নিয়ে। চা ও সামোসা দিয়ে চলে আড্ডা।
অবশেষে মুখ খোলেন রবিশঙ্কর। "বিলায়েত ভাই, সেদিন যা হল তার পুনরাবৃত্তি ভবিষ্যতে না হওয়াই ভালো।" মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালেন বিলায়েত - "হ্যাঁ রোবুদা। আমিও তাই মনে করি।" বলাবাহুল্য, এরপর আর কোনদিন একসঙ্গে সেতার দ্বৈতবাদনে বসেননি রবিশঙ্কর-বিলায়েত খান। দিল্লির বিখ্যাত কন্সটিটিউশন ক্লাবের সেই অনুষ্ঠানই ছিল প্রথম ও শেষ।
এই অবিস্মরণীয় গল্প শুনিয়ে কিষাণ মহারাজ তার শাগির্দদের বলতেন - "ভালো হয়েছে আর তাঁরা (রবিশঙ্কর ও বিলায়েত) একসাথে কখনো বাজাননি। যদি বাজাতেন, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এই দুই উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের কাউকে না কাউকে চিরতরে হারাতাম আমরা। অপূরণীয় ক্ষতির ধাক্কা সামলাতে হত সঙ্গীতজগতকে।"
সময় কেটেছে দ্রুত নিজস্ব নিয়মে। আর কখনও মুখোমুখি হননি ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এই দুই কিংবদন্তি। আলাদা আলাদা স্তরে স্বতন্ত্র অবস্থান বজায় রেখেছেন তাঁরা। কিন্তু দিল্লির কন্সটিটিউশন ক্লাবে তাদের সেই 'এপিক ব্যাটল' যাঁরা যাঁরা মনে রেখেছেন আজও, মাঝেমাঝে সেই স্মৃতিচারণা করে তাঁরা শিহরিত হন। সময়ের নিয়মে ইতিহাস কোথাও না কোথাও ভুলেছে সেই ঐতিহাসিক যুগলবন্দির কথা। সাক্ষী থেকেছে একা শুধু 'মানঝ খাম্বাজ'...
তথ্য ঋণঃ নমিতা দেবীদয়াল রচিত 'The Sixth String of Vilayat খান'.
Powered by Froala Editor