দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম কাঠের নৌকা, ঐতিহ্য সংরক্ষণে বাংলাদেশের হাতিয়ার পর্যটন

নদীর স্রোতে ভেসে চলেছে বিশালায়তন এক পালতোলা কাঠের নৌকা (Wooden Sailboat)। ওজন প্রায় ৬০ টন। অনায়াসেই সেখানে আশ্রয় পেতে পারেন ৬০ জনেরও বেশি মানুষ। বি৬১৩। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম (Largest) কাঠের নৌকা এটিই। চাইলে এই নৌকায় চেপেই ঘুরে বেড়াতে পারেন বাংলার বিস্তীর্ণ নদীপথ। অবশ্য সেই আনন্দ উপভোগ করার জন্য আপনেক পৌঁছে যেতে হবে বাংলাদেশে। 

গঙ্গা-পদ্মা-যমুনা-ব্রহ্মপুত্র— বহু যুগ ধরেই বাংলার ভূমিরূপ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে নদ-নদী। শুধু ভূমিরূপ গঠনই নয়, একটা সময় বঙ্গদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা, জীবিকা, বাণিজ্য সবটাই নির্ভরশীল ছিল নদীর ওপর। সে-সময় গঙ্গা-পদ্মা-ব্রহ্মপুত্রের বুকে রাজত্ব করে বেড়াত প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড কাঠের তৈরি পালতোলা নৌকা। যারা স্থান বিশেষে পরিচিত ছিল ‘মালার’ কিংবা ‘চন্দ্রনৌকা’ বা ‘চাননৌকা’ নামে। অথচ, এই ঐতিহ্যবাহী জলযানই আজ বিলুপ্তপ্রায় বঙ্গদেশে। হারিয়ে যেতে বসা প্রাচীন এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করতেই বছর দশেক আগে বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছিল ‘বি৬১৩’-খ্যাত (B613) কাঠের তৈরি প্রকাণ্ড চন্দ্রনৌকাটি। 

তবে মজার বিষয় হল, বাংলাদেশের নদীপথে ‘রাজত্ব’ করলেও এই নৌকার তৈরির পরিকল্পনা ও তার নকশা নির্মাণের নেপথ্যে রয়েছেন এক অবাঙালি। ইভস মারে। ফ্রান্সে জন্ম ইভসের। যৌবনে সে-দেশের বিমানচালক ছিলেন তিনি। ওড়াতেন ‘এয়ার ফ্রান্স’-এর যাত্রীবাহী বিমান। তবে ধীরে ধীরে নৌকার প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয় তাঁর। আশির দশকের শেষে চাকরি ছেড়ে, ফ্রান্সে নিজের ঘর-বাড়ি বিক্রি করে ছোট্ট নৌকায় চেপে বেরিয়ে পড়েন বিশ্বভ্রমণে। তবে গোটা বিশ্ব ঘুরে দেখা হয়নি তাঁর। বাংলাদেশে পৌঁছানোর পর, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে মোহিত হয়ে, সেখানেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। শুরু হয় গবেষণা। 

ইভসকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল বাংলাদেশের নদীপথ এবং প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী নৌকাদের ইতিহাস। তবে ইভস অবাক হন, এইসব প্রাচীন সংস্কৃতি সংরক্ষণের জন্য সেভাবে কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি বাংলাদেশে। যে-সব নৌকার কথা বইয়ে পড়েছেন তিনি, ছবি দেখেছেন বিভিন্ন মিউজিয়ামে— বাস্তব দুনিয়া থেকে প্রায় সম্পূর্ণভাবেই হারিয়ে গেছে সেগুলি। 

বাংলার এই হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতেই অলাভজনক সংস্থা ‘ফ্রেন্ডশিপ’ প্রতিষ্ঠা করেন ইভস। বিগত আড়াই দশক ধরে বাংলার নৌ-কেন্দ্রিক প্রাচীন ঐতিহ্য সংরক্ষণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এই সংস্থা। হারিয়ে যাওয়া নানান আকারের নৌকাকে ফের জীবিত করে তুলেছে ইভসের এই উদ্যোগ। ২০১১ সালে এই প্রকল্পের আওতাতেই ‘বি৬১৩’ নৌকাটির নকশা তৈরি করেন তিনি। স্থানীয় ছুতোর, কামার এবং পাট-শিল্পীদের দিয়ে তৈরি করান এই বিশেষ নৌকাটি। বর্তমানে এই নৌকা ব্যবহৃত হচ্ছে ‘ফ্রেন্ডশিপ’-এর শাখা সংস্থা তথা নদীভ্রমণ পর্যটন সংস্থা ‘কনটিক’-এ। দক্ষিণ এশিয়ার এই বৃহত্তম পালতোলা নৌকায় চেপে নদীবক্ষে ঘুরে বেড়াতে দেশ-বিদেশ থেকে প্রতিদিনই হাজির হন হাজার হাজার মানুষ। পাশাপাশি ইভসের উদ্যোগে এই নৌকার ছোটো আকারের প্রতিকৃতিও প্রদর্শিত হয়ে চলেছে ফ্রান্স-সহ একাধিক পশ্চিম দুনিয়ার দেশের নানান প্রদর্শনীতে। বলতে গেলে, পর্যটন এবং প্রদর্শনীর মাধ্যমেই বাংলার হারিয়ে গৌরব সংরক্ষণের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ফরাসি উদ্যোগপতি। 

Powered by Froala Editor