মুমূর্ষু রোগীই হোক কিংবা ছোট্ট শিশু— পরিবারের সদস্যদের অনুপস্থিতিতে তাঁদের দেখাশোনার দায়িত্ব নেন তাঁরাই। হ্যাঁ, কথা হচ্ছে আয়াদের নিয়ে। আজকের দিনে ব্যস্ততার সময়ে দাঁড়িয়ে ‘আয়া’ কথাটার সঙ্গে আমরা কম-বেশি পরিচিত সকলেই। কলকাতা-জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র আয়া সেন্টারও। তবে আজ থেকে প্রায় দুশো বছর আগে ব্রিটেনের বুকে গড়ে উঠেছিল আয়াদের জন্য বিশেষ বাড়ি। এবার ঐতিহাসিক সেই বাড়ির গায়েই বসতে চলেছে ব্লু-প্লেক। নেপথ্যে এক ভারতীয় বংশোদ্ভূতার একক লড়াই।
১৮২৫ সালের কথা। লন্ডনের অল্ডগেটে আয়াদের এই বাড়ি গড়ে তুলেছিলেন এলিজাবেথ রজারস নামের এক ব্রিটিশ সমাজসেবী। অমানবিকতা এবং অবিচার থেকে আয়াদের বাঁচাতেই এই আশ্রয়কেন্দ্র তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। হ্যাঁ, অমানবিকতাই বটে। ভারত, চিন কিংবা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে ‘আয়া’ ও ‘নানি’-দের ব্রিটেনে নিয়ে যেতেন সম্ভ্রান্ত শ্বেতাঙ্গরা। এশিয়া থেকে লন্ডন যাত্রার সময়ে জাহাজে শিশু এবং বয়স্কদের দেখাশোনার দায়িত্ব নিতেন তাঁরাই। আর এই কাজের জন্য বড়ো অঙ্কের অর্থের লোভ দেখানো হতে এশীয় আয়াদের। বলা হত, বাড়ি ফেরার জাহাজের বন্দোবস্তও করে দেওয়া হবে। অথচ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্রিটেনে পা দেওয়ার পরেই পরিত্যক্ত করতেন শ্বেতাঙ্গরা। দেওয়া হত না যোগ্য পারিশ্রমিক, ফিরতি পথের জাহাজের টিকিটও। কিছু মানুষ অবশ্য স্থায়ীভাবে কাজ পেতেন লন্ডনে। বাকিদের পথে পথে ভিক্ষা করতে হত, জাহাজের টিকিট কাটার অর্থ জোগাড় করতে।
তাঁদের বিনামূল্যে মাথা গোঁজার ঠাঁই দিতেই তৈরি হয়েছিল লন্ডনের ‘আয়াস’ হোম’। পরবর্তীকালে এই বাড়িই হয়ে ওঠে অলিখিত এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ। হ্যাঁ, শুধু আশ্রয়প্রদানই নয়, অসহায় ‘আয়া’ এবং ‘নানি’-দের কাজ খুঁজে দিত ‘আয়াস’ হোম’। এলিজাবেথের মৃত্যুর পর, বিশ শতকের শুরুর দিকে এই বাড়ি স্থানান্তরিত হয় কিং এডওয়ার্ড স্ট্রিটে। প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব নেয় লন্ডন সিটি মিশন। পরোক্ষভাবে শুরু হয় ভারতীয় আয়াদের ধর্মান্তরিত করার প্রচেষ্টা। বলতে গেলে একটা সময় পরে মিশনারিতেই পরিণত হয়েছিল লন্ডনের এই সুপ্রাচীন ‘আয়া সেন্টার’।
২০১৮ সালে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি একটি বিশেষ তথ্যচিত্র নির্মাণ করে এডওয়ার্ড স্ট্রিটের এই বাড়িটির ওপর। সে-সময়ই প্রকাশ্যে এসেছিল দুশো বছরের পুরনো এই গল্প। আর তার দৌলতেই ইতিহাস অনুসন্ধানে নেমেছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত তরুণী ফারহানা মামুজি। শুরু করেছিলেন অনন্য লড়াই। ব্যক্তিগতভাবে ভারতীয় আয়াদের নথি উদ্ধার করার চেষ্টা করেন ফারহানা। সেইসঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের কাছেও লিখিতভাবে আবেদন করেন যাতে ঐতিহ্যবাহী বাড়িটির গায়ে লাগে ঐতিহাসিক ভবনের তকমা।
শেষ পর্যন্ত এবার সাফল্য পেল তাঁর লড়াই। সম্প্রতি, ভারতীয় আয়াদের অবদানকে স্মরণে রেখে এই বাড়ির সামনে নীল ফলক বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্রিটেন। জীবদ্দশায় যা পাননি ভারত তথা এশীয় আয়ারা, এবার সেই যোগ্য সম্মাননা পেতে চলেছেন তাঁরা…
Powered by Froala Editor