অলীক দুনিয়ার বাস্তবতা নিয়ে সচেতনতা প্রয়োজন সকলেরই

করোনা সভ্যতাকে এক নতুন বাঁকে এনে দাঁড় করিয়েছে। সংক্রমণ ও আতঙ্কের সঙ্গে যুঝতে যুঝতেই হাজারো প্রশ্ন সামনে এসে ভিড় করছে। সেইসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা থেকেই অ্যাডামাস ইউনিভার্সিটি আর প্রহরের যৌথ উদ্যোগে শুরু হচ্ছে আমাদের নতুন ধারাবাহিক কলম - 'প্রসঙ্গ করোনা'। এক-একদিন এক-একটি বিষয়ের সঙ্গে কথা চালাব আমরা। আজ লিখছেন অ্যাডামাস ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক সায়ক পাল। 

ইচ্ছেগুলো ডানা মেলে উড়ে বেড়ায় রঙিন সব দুনিয়ায়, যার মধ্যে বেশিরভাগই হল অলীক; যাকে আমরা প্রায়শই ভার্চুয়াল দুনিয়া বলে থাকি। মজার ব্যাপার হল আমরা অনায়াসেই আমাদের বাস্তবকে ভুলে মেতে থাকি ওই অলীক জগৎ নিয়ে। ধীরে ধীরে মিশে যেতে থাকি ও আপন করে নিতে থাকি ওই অলীক জগতের অর্ধসত্যগুলো। ভুলে যেতে শুরু করি আমাদের বাস্তবকে, সেটা যতই সুন্দর হোক না কেন! আসলে আমাদের ‘পরস্ত্রী ও পরশ্রী’ দুটির প্রতিই মোহের কোনো অন্ত নেই। কেবল ভাবতে থাকি আমার কেন হল না, অপরের কেন হল? বেশ ভালো হত যদি আমরাও অমনি হতাম! 'সোশ্যাল মিডিয়া’ নামক সেই রঙিন দুনিয়াটা আমাদের সেই সুপ্ত কামনা, বাসনাগুলোকে সত্যি করে তোলার প্রলোভন যোগায়। তাই মন্ত্রবলে ষাটোর্দ্ধ বয়স্ক মানুষটি হয়ে যায় তরতাজা তরুণ; যেন সদ্য কলেজ পাশ করে বেরিয়েছে, আবার অপ্রাপ্ত বয়স্ক তরুণী হয়ে যায় তন্বী যার আকর্ষণে আকৃষ্ট হয়ে অশক্ত হয়ে পরে পুরুষের দল। কিন্তু একবার ভাবুন তো যদি এই দুই উদাহরণের দেখা হয় 'সোশ্যাল মিডিয়া'-তে তাহলে বেশ মজার ব্যাপার হবে কিন্তু! কেউ কাউকে চিনতে পারবে না, বুঝতে পারবে না বয়সের ভেদাভেদ। শুধু মেতে থাকবে অলীকের মহিমায়।

এই 'সোশ্যাল মিডিয়া' কিন্তু একটি অদৃশ্য জায়গা বিজ্ঞাপন দাতাদের জন্য। তাই যখন তখনই পর্দায় ভেসে ওঠে বিভিন্ন সংস্থার বিজ্ঞাপন। তবে তার সত্যতা যাচাইয়ের দায়ভার কিন্তু রয়ে যায় যারা সেই বিজ্ঞাপন দেখছে এবং উৎসাহিত হচ্ছে, তাদের উপরেই। এর একটাই কারণ হল কেউ অপর প্রান্তে বসে নেই এইসব বিজ্ঞাপনের সততা এবং সত্যতা যাচাই করার জন্য। আমরা অনেকেই অনেক সময় অনেক জিনিস কিনে ফেলি, তার আক্ষরিক প্রয়োজনীয়তা কতটা আছে আমাদের জীবনে তার বিচার না করেই। যাকে 'Impulsive Buying' বলে থাকেন গবেষকরা। সোশ্যাল মিডিয়া কিন্তু অনেকাংশেই এই 'Impulsive' ক্রেতাদের সহায়তা করে থাকে এবং ক্রমাগত উৎসাহিত করতে থাকে। উদাহরণ স্বরূপ আমাদের চারপাশে ভালোভাবে যদি আমরা লক্ষ্য করি, তাহলে এমন সব জিনিসের নমুনা আমরা দেখতে পাব, যেগুলোর মধ্যে অনেক কিছুরই আমাদের সেভাবে প্রয়োজন নেই কিংবা সামান্য বা অতি সামান্য প্রয়োজন আছে, যা না হলেও বিশেষ কোন পরিবর্তন হবে না আমাদের জীবনে। কিন্তু সেই সকল বিজ্ঞাপনের কল্যাণে তা আমাদের জীবনে জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছে। এটা বিজ্ঞাপনের অন্যতম লক্ষ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম! সেই কারণে বিজ্ঞাপনদাতারা সর্বদা ব্যাস্ত থাকে নিজেদের বিশেষত্ব সর্বসমক্ষে তুলে ধরার জন্য এবং তার গুরুত্ব ও মর্যাদা ক্রেতাদের সমক্ষে শতগুণ বাড়িয়ে তোলার জন্য।

সোশ্যাল মিডিয়ার একটি অন্যতম বিশেষত্ব হল যে এটি সহজেই কোন তথ্য সর্বসমক্ষে তুলে ধরতে পারে এবং একই সঙ্গে সহস্র লক্ষ মানুষের কাছে তা পৌঁছে দিতে পারে অন্যান্য জনপ্রিয় মাধ্যমগুলির মতনই। কিন্তু এর বিশেষত্ব হল দীর্ঘস্থায়িত্ব, যা অন্য মাধ্যমগুলির চাইতে অনেকগুণে বেশি। এখানে সম্প্রচারিত কোনো বিজ্ঞাপন যদি সত্যিই দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হয়, তাহলে তা বারংবার শেয়ার এবং রিশেয়ারের মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপ, পেজ এবং কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে; যা এর স্থায়িত্ব এবং জনপ্রিয়তাকে শতগুণে বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে। অনেক সময়ই দেখা যায় যে কোনো বিজ্ঞাপন, যা পূর্বে সম্প্রচারিত হয়েছিল তা হঠাৎ করেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে কোনো সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে। বিভিন্ন সময়ে এটি প্রত্যক্ষ করা গেছে যে অতি পুরনো কোনো বিজ্ঞাপন হঠাৎ করে জনপ্রিয় হয়ে পড়েছে কোনো এক জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারের মাধ্যমে। এরা অনেক সময় সাহায্য করে কোনো এক পণ্যকে জনপ্রিয় করে তুলতে। কারণ গবেষণায় লক্ষ্য করা গেছে যে এরা তাদের ফলোয়ার্সদের কাছে জনপ্রিয় হওয়ার দরুণ, তাদের পণ্যদ্রব্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে এবং বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিজ্ঞাপন সংস্থা এদের সাহায্য নেয়, তাদের পণ্যদ্রব্যের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধির জন্য।

সোশ্যাল মিডিয়ার আরও একটি গুণ হল, এটির স্থায়িত্ব অন্যান্য মাধ্যমের থেকে অনেক গুণ বেশি কারণ কোনো একটি বিজ্ঞাপন যখন একটি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত হয়, তা দীর্ঘ সময় ধরে সেখানে থেকে যেতে পারে এবং শেয়ার ও রিশেয়ারের মাধ্যমে বহুল প্রচারিত হতে পারে। স্বল্প মূল্যে এরা বহুল প্রচারিত এবং ব্যবহৃত সোশ্যাল মিডিয়ার গুণাগুণের জন্য বহু সংস্থা ইদানিং সোশ্যাল মিডিয়াকে প্রচারের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে এবং বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। সোশ্যাল মিডিয়ার বিজ্ঞাপনের আরও একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হল নতুন প্রজন্মের মধ্যে এই মাধ্যমের জনপ্রিয়তা সবথেকে বেশি এবং বিভিন্ন বিজ্ঞাপন সংস্থার লক্ষ্যস্থল থাকে এই বয়সের ক্রেতারা, যাদের মধ্যে 'Impulsive Buyers' দের সংখ্যা নেহাত কম নয়।  

এই অভূতপূর্ব মাধ্যম বিজ্ঞাপন দাতাদের একান্ত আকর্ষণের জায়গা হলেও একই সাথে নানান ভেকধারী বিজ্ঞাপন দাতাদের অর্থ উপার্জনের পন্থাও হয়ে দাড়িয়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। তাই প্রতিনিয়ত অপদস্থ এবং আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে বহু ক্রেতাদের, যা ধীরে ধীরে ভঙ্গ করছে ক্রেতাদের বিশ্বাস বিক্রেতাদের উপর এবং দীর্ঘ সময় ধরে এভাবে চলতে থাকলে ও প্রতিকার না হলে সমূহ ক্ষতি সৃষ্টি করতে পারে সমগ্র বিজ্ঞাপন জগতের জন্য। এই সকল প্রতারকদের চক্রান্তে বহু মানুষের সমূহ ক্ষতি হতে পারে বিভিন্ন ভাবে এবং মানুষের আস্থা উঠে যায় বিজ্ঞাপন দাতাদের উপর থেকে। যেখানে আস্থা হল বিজ্ঞাপন জগতের অন্যতম স্তম্ভ।  বিজ্ঞাপন সংস্থা গুলি এবং বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রপ্রস্তুতকারক সংস্থাগুলি বহু সময় এবং বহু অর্থ ব্যয় করে ক্রেতাদের মনে বিশ্বাস ও আস্থা তৈরি করে তাদের প্রোডাক্ট কিংবা সার্ভিসের জন্য। মজার কথা হল, এই বিশ্বাস অর্জন করতে যতটা না সময় লাগে, তার চেয়ে অনেক অল্প সময় লাগে ক্রেতাদের মধ্যে এই বিশ্বাস ভঙ্গ করতে। বিভিন্ন সময়ে এমন কিছু বিজ্ঞাপন দেখা যায় যারা ইচ্ছাকৃত ভাবে ভুল পাবলিসিটি করে অপর কোন ব্র্যান্ডের ক্ষতি সাধন করার জন্য। যদিও এটা অনুচিত কাজ, কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে এটি অনায়াসেই হয়ে থাকে, যা সেই সংস্থার জন্যে ভীষণ ভাবে ক্ষতিকারক।

সোশ্যাল মিডিয়ার অবদান অবশ্যই অনস্বীকার্য এবং এই পরিস্থিতিতে যখন করোনার প্রকোপে মানুষ গৃহবন্দি, তখন সোশ্যাল মিডিয়াই হল একমাত্র জায়গা যেখানে মানুষ তার মতামত নির্ভয়ে ব্যক্ত করতে পারে, তুলে ধরতে পারে তার বক্তব্য এবং একই সঙ্গে ব্যক্ত করতে পারে তার অভিমত অপরের সম্পর্কে! এই স্বাধীনতার মাধ্যমে আমরা অনেক সময়ই ভুলে যাই আমাদের পরিধি এবং ঠিক ও বেঠিকের মধ্যেকার পার্থক্য। এর জন্য অবশ্য অনেক ক্ষেত্রেই দায়ী সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সাররা, যাদের কার্যকলাপ প্রভৃত ভাবে প্রভাবিত করে বহু মানুষকে যারা নিয়মিত ভাবে সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন কার্যকলাপে লিপ্ত থাকে। ব্যবহারকারীদের সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে যে তারা যেন এই রকম কোন প্রলোভনে পা না দেন এবং জানা মাত্র অপরকে সতর্ক করেন এই সকল চক্রান্ত থেকে। বিভিন্ন দেশের মতো ভারতেও সাইবার আইনের প্রভাবে সোশ্যাল মিডিয়ার তথ্যের উপর নজরদারি চলে এবং যে কোনো আপত্তিকর কন্টেন্ট অবিলম্বে তুলে নেওয়া হয় সেই মাধ্যম থেকে। তাই বিজ্ঞাপন দাতা এবং সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী উভয়েরই প্রয়োজন সতর্ক থাকার এবং কোনো আপত্তিকর কন্টেন্টের সম্পর্কে আসা মাত্রই তা বর্জন ও অভিযোগ জানানো। 

Powered by Froala Editor

More From Author See More