সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার একটি দিবাভাগকে শাস্ত্রে বলে 'কল্প', যার দৈর্ঘ্য ৪৩২ বিলিয়ন সৌর বৎসর! কতকটা মানুষের মতোই, কল্পের শুরুতে ব্রহ্মা জেগে ওঠেন, বিবিধ সৃষ্টির খেলায় মেতে ওঠেন, এবং কল্পের শেষে এই খেলা সাঙ্গ হয়, সমস্ত জগত লয় হয়ে যা অবশিষ্ট থাকে, মেধা ঋষি তাকে বলেছেন 'একার্ণব'— এক অকূল অপার মহাসমুদ্র। এই একার্ণবে অনন্তশয়ান নারায়ণের নাভিকমলে ব্রহ্মা নিদ্রা যান। নেমে আসে চরাচরব্যাপিনী রাত্রি। সেই অকল্পনীয় দীর্ঘ রাত্রির অবসানে, পুনরায় ব্রহ্মা জেগে ওঠেন, নব কল্পে নব সৃষ্টির পত্তন করেন। গবেষকেরা আশ্চর্য হয়ে দেখেছেন, পৃথিবীর নানা দেশে, বিচিত্র বিশ্বাসে আস্থাশীল মানুষ সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে যে বিচিত্র কাহিনিসম্ভার পরম্পরাক্রমে বয়ে এনেছে, তার প্রায় সবখানেই আছে সৃষ্টির শুরুতে এই অনন্ত জলরাশির বৃত্তান্ত। যাকে দুর্গাসপ্তশতী বলেন, 'একার্ণব'।
দূরদর্শনের কল্যাণে দেবী দুর্গার (Devi Durga) বিবিধ রূপের কাহিনি এখন অনেকেরই জানা। কিন্তু, দেবীর এই সমস্ত রূপের মধ্যে কে কখন এলেন? কোন সময়ে ঘটল কোন অবতারের আবির্ভাব?
প্রথমে ভারতীয় বেদানুগ শাস্ত্রে সময়ের ধারণাটা ঠিক কীরকম, সংক্ষেপে বলে নেওয়া যাক। পশ্চিমের শাস্ত্রে সময়ের ধারণাটি অনেকটা একমুখী সরলরেখার মতন, কিন্তু পুবের সময়রেখা বৃত্তাকার। বারে বারে সৃজন, পালন, লয়ের পুনরাবর্তনের কথা বলে ভারতের শাস্ত্রমালা। তাই, ভারতের কবি লেখেন, "যেথা শেষ হয়/সেইখানে পুনরায় আরম্ভ উদয়।"
যদি আরও সূক্ষ্ম ভাগ করা যায়, তাহলে দেখি, সহস্র চতুর্যুগের সমাহারে এক একটি কল্প গঠিত। অর্থাৎ প্রতিটি কল্পে সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি— এই চারযুগের চক্রাবর্তন ঘটে মোট হাজারবার। এবং প্রতিটি কল্পে মোট চৌদ্দজন মনু মানবজাতির অধিপতিরূপে রাজত্ব করেন, একেক মনুর শাসনকালকে বলে 'মন্বন্তর' (মোটামুটি একাত্তর চতুর্যুগ)। বর্তমানে চলছে সপ্তম মনুর রাজত্বকাল, বৈবস্বত মন্বন্তর। এই মন্বন্তরের সাতাশটি চতুর্যুগ অতিক্রান্ত, আমরা এখন রয়েছি অষ্টাবিংশতি চতুর্যুগের অন্তর্গত অন্তিম যুগে, অর্থাৎ কলিযুগে।
আরও পড়ুন
ঢাকেশ্বরীর আদলে কলকাতায় অষ্টধাতুর দুর্গামূর্তি, এখনও চলছে সেই পুজো
মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্ভুক্ত দুর্গাসপ্তশতীতে রয়েছে দেবীর শাশ্বত অভয়বার্তা— যখনই দানবগণ এই বিরাট ব্রহ্মাণ্ডের সুষ্ঠু পরিচালনায় বাধা দেবে, তখনই তিনি বিবিধরূপে অবতীর্ণ হবেন, শত্রু-সংহার করবেন। ভগবতীর এই অসুরবিনাশ লীলার বর্ণনা রয়েছে দুর্গাসপ্তশতীর তেরোটি অধ্যায় জুড়ে। তাঁর বিবিধ অবতারমূর্তির দৃশ্যরূপের বর্ণনা পাচ্ছি শ্রীশ্রীচণ্ডীর উপসংহার-অংশে, যার নাম 'রহস্যত্রয়'। আর এই সমস্ত লীলা কখন ঘটেছিল বা ঘটবে, সেই সময়রেখার একটা হিসেব আমরা পাচ্ছি লক্ষ্মীতন্ত্রের নবম অধ্যায়ে, ভগবতী মহালক্ষ্মীর বাণীতে। একটু সহজ করে বলা যাক।
রহস্যত্রয়ের প্রথম খণ্ড অর্থাৎ প্রাধানিক রহস্যে মেধা ঋষি বলছেন আদ্যাদেবী মহালক্ষ্মীর বৃত্তান্ত। ইনি ত্রিগুণময়ী পরমেশ্বরী, সকল সৃষ্টির আদি কারণ, সর্বব্যাপিনী, অপার শূন্য এঁর তেজেই পূর্ণ। এঁর রূপ কেমন? ইনি তপ্তকাঞ্চনবর্ণা, স্বর্ণালঙ্কারভূষিতা, চতুর্ভুজা। মহালক্ষ্মীর চার হাতে শোভা পাচ্ছে মাতুলিঙ্গ, গদা, খেটক ও পানপাত্র। এঁরই রূপান্তরিত প্রকাশ হলেন তামসীমূর্তি মহাকালী, এবং সাত্ত্বিকীমূর্তি মহাবাণী। অত:পর এই তিন মহাশক্তি সৃষ্টি করলেন তিনটি দেবমিথুন, তাঁরা পেলেন জগৎ-পরিচালনার দায়িত্ব। সরস্বতী ও ব্রহ্মা পেলেন সৃষ্টির দায়িত্ব, লক্ষ্মী ও নারায়ণ পেলেন স্থিতির দায়িত্ব, গৌরী ও রুদ্র পেলেন প্রলয়ের ভার। সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের মাধ্যমে সংসারচক্রের আবর্তন আরম্ভ হলো।
আরও পড়ুন
দুর্গাপুজোয় খরচ ১৭ টাকা, শক্তি-আরাধনা করেই কপাল ফিরল সাহেবের
এই আদিদেবী মহালক্ষ্মীর বিগ্রহ রয়েছে মহারাষ্ট্রের কোলাপুরে। লোকবিশ্বাস অনুসারে, ইনি ভগবান তিরুপতির সহধর্মিণী।
আরও পড়ুন
দুর্গাপুজোর পদ্ধতি নিয়ে শাক্ত-বৈষ্ণবে বিবাদ, সমাধান মিলল সিংহে
রহস্যত্রয়ের দ্বিতীয় ভাগের নাম 'বৈকৃতিক রহস্য', এতে রয়েছে মহাদেবীর তিনটি প্রধান অবতারমূর্তির বিবরণ।
প্রথম, মহাকালী। কল্পান্তে, অর্থাৎ নূতন সৃষ্টিলীলা আরম্ভ হবার পূর্বে এঁর আবির্ভাব। মধু আর কৈটভ নামক দুই অসুরের ভয়ে ত্রস্ত ব্রহ্মা নারায়ণকে জাগরিত করবার জন্য হরিনেত্রবাসিনী যোগনিদ্রার স্তব করলেন। বিষ্ণুদেহ থেকে মহাদেবী আবির্ভূতা হলেন মহাকালী মূর্তিতে। কেমন সেই রূপ? ঘোর কৃষ্ণবর্ণা তিনি, তাঁর দশটি মুখ, দশটি হাত, দশটি চরণ। দশভুজার দশটি হাতে খড়গ, শূল আদি বিবিধ আয়ুধ। এই মহাকালীর লীলাচাতুর্যেই ঘটল নারায়ণের নিদ্রাভঙ্গ, এবং হরির হাতে বিনষ্ট হল সৃষ্টির অন্তরায় দুই অসুর— মধু ও কৈটভ। শ্রীশ্রীচণ্ডীর প্রথম অধ্যায়ে বর্ণিত মহাকালীর লীলা, যাকে বলা হয় 'প্রথম চরিত্র'।
দ্বিতীয়, মহালক্ষ্মী। কল্পের শুরুর দিকে, প্রথম মনুর রাজত্বকালে অর্থাৎ স্বায়ম্ভুব মন্বন্তরে এঁর আবির্ভাব। মহিষাসুর-পীড়িত তিন ভুবনকে রক্ষা করতে, সমগ্র দেবগণের তেজ একত্রীভূত হয়ে ঘটল মহালক্ষ্মীর আবির্ভাব। তিনি বিচিত্রবর্ণা, অষ্টাদশভুজা, সিংহবাহিনী। তাঁর হাতে শোভা পাচ্ছে বিবিধ দেবতার উপহার ত্রিশূল, সুদর্শন, বজ্র, খড়গ আদি বিবিধ আয়ুধ। তিনিই মহিষাসুরমর্দ্দিনী দুর্গা, শ্রীশ্রীচণ্ডীর 'মধ্যম চরিত্র' অর্থাৎ ২-৪ অধ্যায় জুড়ে এই দেবী দুর্গার লীলাবিলাস।
তৃতীয়, মহাসরস্বতী। চতুর্থ মন্বন্তরে, অর্থাৎ তামস মনুর রাজত্বকালে শুম্ভ-নিশুম্ভের পীড়নে ত্রস্ত দেবকুলকে রক্ষা করতে দেবীর অবতরণ। পার্বতীর শরীরকোষ থেকে তাঁর আবির্ভাব, তাই তাঁর নামান্তর কৌষিকী। তিনি শ্বেতবর্ণা, অষ্টভুজা, হল-মুষলাদি নানা আয়ুধে পরিশোভিতা। অসুররাজ শুম্ভকে বধদণ্ড দেবার আগে দেবী উচ্চারণ করেন তত্ত্বজ্ঞান, ‘একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা’, এই সমগ্র জগতে অপর কেউ নেই, কেবল আমিই আছি। আমি এক, আমি অদ্বিতীয়। শ্রীশ্রীচণ্ডীর 'উত্তম চরিত্র' অর্থাৎ অধ্যায় ৫-১৩ অবধি এই মহাসরস্বতীর লীলাবর্ণনা।
'চণ্ডীচিন্তা' গ্রন্থে মহানামব্রত ব্রহ্মচারী এই ত্রিমূর্তির তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে বলেছেন,
"মহাকালিকা অন্ধকারবর্ণা। সকল তত্ত্ব সেথায় অব্যক্ত। মহালক্ষ্মী বৈচিত্র্যতময়ী, নিখিল তত্ত্ব সেথায় সুপরিস্ফূট। মহাসরস্বতী শুভ্র জ্যোৎস্নাধবল, নিখিল বৈচিত্র্যের পরম একত্বে পর্যবসান। তন্ত্রের তত্ত্বের এই ছক (formula) বিরাটের সামগ্রিক জীবনে যেরূপ সত্য, অণুচৈতন্য ব্যক্তির ক্ষুদ্র জীবনেও সেইরূপ সত্য।"
শ্রীশ্রীচণ্ডীর একাদশ অধ্যায়ে দেবী তাঁর ভবিষ্য অবতারদের বৃত্তান্ত সংক্ষেপে উপদেশ করেছেন। বৈবস্বত মন্বন্তরের ২৮ সংখ্যক চতুর্যুগের অন্তর্গত দ্বাপরে তিনি আসবেন নন্দপুত্রী রূপে, তাঁর নাম হবে 'সুনন্দা'। বিন্ধ্যপর্বতে ঘটবে দেবীর অসুর-বিনাশ-লীলা। বিপ্রচিত্তি বংশের অসুরদের বিনাশ করতে আবার আসবেন দেবী, তখন অসুররক্তপানোন্মত্তা সেই দেবীর নাম হবে 'রক্তদন্তিকা'। ৪০-তম চতুর্যুগে, অনাবৃষ্টিপীড়িত ভুবনকে রক্ষা করতে 'শতাক্ষী' মূর্তিতে আবির্ভূতা হবেন দেবী, মেঘবরণা দেবীর অশ্রুজল নয়দিন ধরে প্রবল বর্ষণে সিক্ত করবে ঊষর ভূমি, শাকাদির দ্বারা জীবজগতের ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করে তিনি ধরবেন 'শাকম্ভরী' নাম। অতঃপর দুর্গমাসুরকে বধ করার কারণে তাঁর নাম হবে 'দুর্গা'। ৫০-তম চতুর্যুগে হিমাচলে রাক্ষসবধার্থে আবির্ভূতা হবেন দেবী, তাঁর সেই ভয়ঙ্করী মূর্তির নাম হবে 'ভীমা'। ৬০-তম চতুর্যুগে আবার আসবেন জগজ্জননী, 'ভ্রামরী' রূপ ধরে বধ করবেন অরুণাসুরকে। এই অনন্ত অবতারলীলার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আমরা পেলাম শ্রীশ্রীচণ্ডীর একাদশ অধ্যায়ে। এই দিব্যমূর্তিগুলির বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যাবে রহস্যত্রয়ের অন্তর্গত অন্তিম অধ্যায়ে, যার নাম 'মূর্তিরহস্য'।
আর এই যে বিশাল বহুস্তরীয় কাহিনি, এই কাহিনি বর্ণনার সময়কালটি কী? লক্ষ্মীতন্ত্র থেকে জানা যাচ্ছে, দ্বিতীয় মন্বন্তর অর্থাৎ স্বারোচিষ মনুর রাজত্বকালে রাজ্যভ্রষ্ট সুরথ ও তাঁর বন্ধু সমাধির কাছে এই চণ্ডীবৃত্তান্ত বর্ণনা করেছেন বশিষ্ঠ মুনি (মার্কণ্ডেয় পুরাণমতে মেধা মুনি)। মুনির উপদেশ মেনে কঠোর তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করেছেন সুরথ, দুর্গার আশীর্বাদে হৃত রাজ্য পুনরুদ্ধার করেছেন। বর্তমান মন্বন্তর শেষ হলে, জন্মান্তরে এই সুরথই হবেন অষ্টম মনু। তখন তাঁর নাম হবে সাবর্ণি।
শেষ করার আগে আরেকটা প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যাক। দেবীর এতগুলি অবতারের মধ্যে কালের বিচারে আমাদের সবচেয়ে নিকটে আছেন কে? উত্তর, সুনন্দা। লেখার শুরুতেই বলেছিলাম, এখন চলছে সপ্তম মনুর রাজত্বকাল, বৈবস্বত মন্বন্তর। এই মন্বন্তরের ২৮-তম চতুর্যুগের অন্তিম অংশে, অর্থাৎ কলিযুগে আমাদের অবস্থান। আর এই কলিযুগের ঠিক আগে, দ্বাপর যুগে, গোকুলে নন্দ-যশোদার গৃহে এসেছিলেন দেবীর সাম্প্রতিকতম অবতারমূর্তি। তিনিই সুনন্দা, কৃষ্ণের ভগিনী। নামান্তরে তিনি যোগমায়া, একানংশা, নারায়ণী। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণানবমীতে তাঁর আবির্ভাব, তার ঠিক এক মাস পরে, আশ্বিনের কৃষ্ণানবমীতে শারদোৎসবের প্রথম কল্পারম্ভ, দেবীর বোধন। আর কিছুদিন পরেই শুক্লানবমী, যার নামান্তর মহানবমী, দুর্গোৎসবের তুঙ্গমুহূর্তের উদযাপন।
শুভ হোক শারদোৎসব।
Powered by Froala Editor