রেললাইনের ওপর পড়ে আছে খান কয়েক রুটি। নিটোল, গোল; কেউ এতটুকুও বিকৃতি ঘটায়নি সে চেহারায়। কিংবা খাওয়ার কথাই ভাবছিল কেউ, খানিক বিশ্রাম করে দুটো টুকরো মুখে দেবে। শেষ পর্যন্ত কিছুই হল না। রেললাইনের কালো নোংরা পাথরগুলোর পাশে জায়গা হল খাবারগুলোর। আর মানুষগুলো? খানিক দূরে ওদের দলাপাকানো দেহ পড়ে রয়েছে। সুকান্ত যথার্থই বলেছিলেন একদিন। বুদ্ধ পূর্ণিমার ভরা চাঁদ পরিযায়ী শ্রমিকদের শুখা পেটে আঘাত করে…
করোনা নিয়ে আমরা সকলেই চিন্তিত। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের মতামত জানাচ্ছি, লাইভে আসছি। কত তত্ত্ব, কত রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব! এরই ফাঁকে দেশের একটা বড়ো অংশের মানুষ আধথালা ভাতের কথা চিন্তা করছেন। তাঁদের কাজ নেই আজ, সংসারে লক্ষ্মী আসবে কিনা জানা নেই। এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে, পথের ধারে পড়ে আছেন তাঁরা। কখনও পুলিশের মার, কখনও অনাহারে মৃত্যুর হাহাকার। করোনার থেকে কি কম বাস্তব ভারতের পরিযায়ী শ্রমিকরা?
তার ওপর ঔরঙ্গাবাদের ঘটনা খাদের ধারে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে সমাজকে। ঠিক কতটা ক্লান্ত, শ্রান্ত হলে কয়েকজন মানুষ রেললাইনের ওপর ঘুমিয়ে পড়তে পারে? কতটা অসহায় হলে মালগাড়ির আওয়াজও শুনতে পান না তাঁরা? এভাবেই আমাদের চারপাশের একটা বড়ো অংশ অসাড় হয়ে যাচ্ছে; আর আমরা দেখেও গান্ধারী সেজে আছি! সত্যিই কি এত গভীর ঘুম ছিল ওই পরিযায়ী শ্রমিকদের? বিকল্প তত্ত্বের কথাও তুলে আনছেন কেউ কেউ। এসব শুনে প্রশ্ন জাগছে অনেকের মনেই, মানুষগুলো আগে থেকেই চিরনিদ্রায় তলিয়ে যাননি তো? নিথর শরীরগুলোর ওপর দিয়ে চলে যাওয়া ছাড়া মালগাড়ির আর কিছু করার ছিল না হয়তো। যদিও রেল কর্তৃপক্ষ এ-তত্ত্বে শিলমোহর দেয়নি। তাঁদের সরকারি বয়ানে এই ঘটনা দুর্ঘটনা হিসাবেই আখ্যা পেয়েছে। হয়তো দুর্ঘটনাই। কিন্তু তারপরেও প্রশ্ন থাকে। দিনের শেষে আসল ছবিটা তো ওই আধপোড়া রুটিগুলো। বর্তমান ভারতের একটা বড়ো ছবি ওই রুটির পাশে পড়ে আছে; নিথর, নিঃস্ব হয়ে। যারা বেঁচে আছেন, লড়াই করছেন, হয়ত তাঁরাও একদিন এভাবেই…
বিশাখাপত্তনমের কিছু গ্রামে মানুষজন ঘুমিয়েছিল। তাঁদের সেই শান্তি কেড়ে নিল কিছু বিষাক্ত গ্যাস। একের পর এক মানুষ বেরিয়ে আসছে রাস্তায়, মাটিতে পড়ে যাচ্ছে অজ্ঞান হয়ে। সোশ্যাল ডিসটেনসিং, আইসোলেশন সবকিছু তখন পর্দার পেছনে। মানুষ ছুটছে অসহায়ের মতো। বিশাখাপত্তনমের এই গ্যাস দুর্ঘটনার জন্য কাকে দায়ী করা হবে? যারা মারা গেছেন, যারা যাননি, প্রত্যেকেই দুর্ভোগে পড়বেন এবার। যারা আহত, আক্রান্ত— তাঁরা কোনোদিনও সুস্থ জীবন ফিরে পাবেন? বহুজাতিক সংস্থা, বাজারে অনেক নাম, শেয়ার বাজারেও ভালো ডিমান্ড। তাঁদের দায়িত্বজ্ঞানের ছবি তো কয়েকদিন আগেই গোটা দেশ দেখল। ঠিক যেমন আশির দশকে দেখেছিল ভূপাল। পুঁজিপতি, কর্পোরেট ও ধনতন্ত্রের কাছে মুখ থুবড়ে পড়ছে পেটে ভেজা গামছা জড়িয়ে শুয়ে পড়া মানুষগুলো…
আমাদেরই বা কী করার আছে বলুন? গুদামঘর থেকে খাবার সরে যাচ্ছে রাতারাতি, আর শুকনো রুটির পাশে রক্তমাখা কাপড় লুটোপুটি খাচ্ছে। এরপর হয়ত আন্দোলন হবে, জলকামান আসবে, জেল ভর্তি হবে; বৈষম্য মুছবে কি? করোনা ভারতের আসল স্বরূপটা বারবার তুলে নিয়ে আনছে না তো? দিনের শেষে, আরও কয়েক হাজার মানুষ না খেতে পেয়ে, বিষের জ্বালায় পঙ্গু হয়ে রেললাইন বা ফুটপাতে লুটিয়ে পড়বে। যেতে আসতে হয়ত কেউ এক টাকার কয়েন দেবেন, কেউ দিয়ে দেবেন ছেঁড়া নোটটা। আর পূর্ণিমার বাসি চাঁদ হয়ে পড়ে থাকবে তিন-চার টুকরো রুটি আর পচা ভাত…
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)