স্যালুট না জানানো এক বিষণ্ণ বাবা আর ইতিহাস হয়ে যাওয়া সেই ছবির গল্প

জার্মানির সরকারে তখন ন্যাশনাল সোসালিস্ট পার্টি ওরফে নাৎসি পার্টি। হিটলার তাঁর গরম গরম বক্তৃতায় ব্যক্ত করছেন আর্যজাতির মাহাত্ম্য। চলছে ইহুদিদের উপর ব্যাপক অত্যাচার, ধরপাকড়। হাইমলার-গোয়েরিং-এর নেতৃত্বে আউসিৎসে গড়ে উঠছে কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি ধুঁকছে, চাকরি নেই, অনাহারে মরছে মানুষ। হিটলার এক শক্তিশালী দেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। মানুষও দেখেছিল সেই স্বপ্ন। যে স্বপ্নের পরতে পরতে লুকোনো পারস্পরিক ঘৃণা আর অবিশ্বাসের বীজ…

অগাস্ট ল্যান্ডমেসার ছিলেন একজন সাধারণ শ্রমিক। হামবুর্গ-এর এক জাহাজখানায় কাজ করতেন। নেহাত পেটের দায়ে নাম লিখিয়েছিলেন নাৎসি পার্টিতে। কিন্তু ভালোবেসেছিলেন ইহুদি বংশোদ্ভূত ইরমা একলারকে। কুখ্যাত নুরেম্বুর্গ আইন তাঁদের বিবাহের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তার পরেও ঘর বাঁধেন ল্যান্ডমেসার আর ইরমা। এহেন ‘অনৈতিক দাম্পত্যের’ খবর পেয়েই পার্টি বহিষ্কার করে অগাস্টকে। ততদিনে জন্ম নিয়েছে নবদম্পতির প্রথম কন্যাসন্তান ইনগ্রিড। ওঁরা ঠিক করেছিলেন, পালিয়ে যাবেন দেশ ছেড়ে। ডেনমার্কে। সেখানে নতুন ঘর বুনবেন। একটা যৌথ সুন্দর স্বপ্ন অবয়ব পাবে। কিন্তু, গেস্টাপোর খাঁচায় ধরা পড়ে যান। নিরুপায় অগাস্ট বারংবার স্ত্রী-র আর্যত্ব প্রমাণের চেষ্টা চালিয়েছিলেন। লাভ হয়নি কোনো।

অগাস্ট আর ইরমাকে আলাদা-আলাদা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছিল। মৃত্যুর আগেই বিচ্ছেদের শাস্তি। ইরমা তখন অন্তঃসত্ত্বা। ক্যাম্পেই জন্ম হয় তাঁদের দ্বিতীয় সন্তানের। নাম আইরিন। মৃত্যু-খাঁচার মধ্যেই জন্ম তার।

তারপর, প্রায় ১৪,০০০ মানুষের সঙ্গে প্রাণ হারিয়েছিলেন ইরমা। আর অগাস্ট মারা যান যুদ্ধক্ষেত্রে। ক্রোয়েশিয়ার মাটিতে। রাজনৈতিক বন্দীদের দিয়ে গড়া একটি দলের সৈনিক হয়ে।

মেয়েদুটি অবিশ্যি বেঁচে গিয়েছিল। ক্যাম্পের ভয়ঙ্কর স্মৃতি বয়ে বেড়িয়েছে তারা সারাজীবন। গভীর রাতেও হয়ত নাকে ছলকে এসে লেগেছে গ্যাস চেম্বার থেকে বেরোনো ঝাঁঝালো গন্ধ। দুঃস্বপ্নে হানা দিয়েছে নিথর শরীরের পাহাড়। লাশ বয়ে নিয়ে যাওয়া গাড়ি। তাদের মা-ও যে…

আর ছিল একটা ছবি। ইতিহাস হয়ে যাওয়া, প্রতীকী হয়ে যাওয়া একটা ছবি। ছবিটা তোলা হয়েছিল ১৯৩৬ সালের ১৩ই জুন, হামবুর্গ শহরের বিখ্যাত জাহাজখানায়। হাজার-হাজার নাৎসি স্যালুটের ভিড়ে একটি মানুষ বুকে আড়াআড়ি হাত রেখে দাঁড়িয়ে। আনুগত্যের নিয়মের মধ্যে বড় তীব্রভাবে চোখে পড়া ব্যতিক্রম। দৃষ্টি বিষণ্ন এবং বিদ্রোহীও। আইরিন একলার এক লহমায় দেখে চিনেছিলেন তাঁর বাবাকে। অগাস্ট ল্যান্ডমেসার।

মৃত্যু উপত্যকায় সেদিন ফুটেছিল ভালোবাসার কুঁড়ি।