“আমার নিজের বাড়ি এখান থেকে অনেক দূরে। আর মেদিনীপুরে যেখানে থাকি, সেটাও বেশ দূরেই। সকাল, বিকেল, রাত— প্রায় সব শিফটেই আমায় কাজ করতে হয়। আমার পেশাটাই তো সেরকম। করোনার সময় সমস্ত রোগীরা আসছেন। এমনি রোগীরাও আছেন। আমাকে তো থাকতেই হবে। চিকিৎসা তো করতেই হবে। তা না হলে তাঁরা যাবেন কোথায়? আমরা ডাক্তাররা প্রতিদিন প্রাণ দিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু আমরা কতটা সচেতন হচ্ছি, সেটা তো প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।”
প্রহরকে বলছিলেন ডাঃ আঙ্গুকাতো। পশ্চিম মেদিনীপুর সরকারি হাসপাতালের সার্জেন। বাড়ি সুদূর নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে। সেখান থেকে সব ছেড়ে ছুঁড়ে এখানে এসেছেন। নিজের পরিবার এখনও রয়েছে ওখানে। কিন্তু ডাক্তারির মহৎ ধর্ম থেকে পিছপা হননি তিনি। বিশেষ করে এই করোনার সময়ও কাজ করে যাচ্ছেন প্রবলভাবে। প্রসঙ্গত, নাগাল্যান্ডে এখনও অবধি করোনার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। আঙ্গুকাতো ফিরেই যেতে পারতেন। নিজের পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে পারতেন। তা করেননি তিনি; চলে গেলে এই মানুষগুলোর কী হত? সারাটা সময় রোগী তো দেখছেনই, সঙ্গে সবাইকে নিজের ফোন নাম্বারও দিয়ে দিয়েছেন। যাতে দরকার পড়লে সরাসরি ডাক্তারকেই যেন পাওয়া যায়।
এতদূর অবধি সব ঠিকই ছিল। সচেতনতার প্রশ্নটি এল কয়েকদিন আগেই। কাজ সেরে নিজের বাড়ি ফিরছিলেন ডাঃ আঙ্গুকাতো। প্রসঙ্গত, পশ্চিম মেদিনীপুরে তাঁর আস্তানা স্থানীয় রসায়ন শিক্ষক বিশ্বজিৎ দে-র বাড়িতে। সেখানেই ফিরছিলেন তিনি। এমন সময় বাইক নিয়ে হাজির হয় বেশ কিছু যুবক। শুরু হয় অকথ্য গালাগাল, বিদ্বেষমূলক মন্তব্য। লক্ষ্য ডাঃ আঙ্গুকাতো, যিনি রাতদিন এই মানুষগুলোর কথাই ভেবে যাচ্ছেন। তিনি যে ভারতীয়, নাগাল্যান্ডের বাসিন্দা; আর সেখানে করোনা হয়নি— এই কথাগুলো শোনার পরিস্থিতিতেই ছিলেন না ওই যুবকরা। তাঁদের বক্তব্য, এই ‘নেপালি’, ‘চিন’ ডাক্তাররাই করোনা ছড়িয়ে দিচ্ছে সব জায়গায়। তাই একে উচিত শাস্তি দিতে হবে। প্রতিবাদ করতে গেলে ডাক্তারের ওপর আক্রমণও করা হয়!
শুধু ডাঃ আঙ্গুকাতো নন, এরকম ঘটনা দিনের পর দিন ঘটে চলেছে চারিদিকে। সচেতনতার অভাব যে কী পরিমাণে জাঁকিয়ে বসেছে, এইসব ঘটনার নৃশংসতাই প্রমাণ করে। কখনও ডাক্তারদের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া, কখনও এইভাবে মিথ্যে আরোপ দিয়ে আক্রমণ করা— এটাই কি আমাদের প্রতিদান? ডাঃ আঙ্গুকাতো’র মতো মানুষরা সবটুকু দিয়ে আমাদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। যাতে সবাই মিলে আমরা ভালো থাকি। আর আমরা?
এক্ষেত্রে অবশ্য আঙ্গুকাতো’র পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তাঁর বাড়িওয়ালা বিশ্বজিৎ। পুলিশের কাছে অভিযোগও দায়ের করেন তিনি। শুধু তাই নয়, ডাক্তারদেরও যে মানসিক জোর লাগে, সেটাও বুঝেছেন তিনি। তাই নিজের আত্মীয়ের মতোই ডাঃ আঙ্গুকাতোর সঙ্গে রয়েছেন তিনি। আমরা সবাই এখান থেকে খানিক শিক্ষাও নিতে পারি। এরপর কাউকে ‘নেপালি’, ‘চিন’ বলার আগে দুবার, দশবার নয়; হাজার বার যেন ভাবি। আর ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশে যেন দাঁড়াই। ওঁরা না থাকলে কিন্তু আজ আমরা অসহায়!