হয়তো আগের রাত্রেই আকণ্ঠ মদ্যপান করেছেন সাহেব। কলকাতার গরমে হাঁসফাঁস দশা। রাতটুকু কাটবে কি? নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না কিছুতেই। ঘণ্টা ছয়েক কাটতে না কাটতেই নেমে এল মৃত্যু। যে বাড়িতে আগের রাতে বসেছিল মদের আসর, সেই গৃহকর্তাই বহন করছেন মৃত সাহেবের দেহ। মৃত, না মাতাল?
আঠেরো-উনিশ শতকে কলকাতার মাতাল তালিকাটা একটু অন্যরকম। দিশি মাতাল শুধু পথঘাট আলো করত না। বিদেশি মাতালের মাতালত্বের কাছে তারা প্রায়শই পরাজিত হত। অর্ধোলঙ্গ সাহেব মাতাল দুর্বোধ্য লিরিক্স আওড়ে বউবাজার মোড়ে উদ্বাহু নৃত্য করছে - এ দৃশ্যও কলকাতার শহরজন্মের এক ইতিকথা। তাকে অস্বীকার করার জো নেই।
ছিল জঙ্গুলে পগারময় এলাকা। হয়ে গেল পেল্লায় শহর। কলকাতার এই রূপান্তরের হাজারও কিসসা। নানানভাবে তাকে ব্যাখ্যা করা যায়। করা হয়ও। অনেক সাহেব-মেম কলকাতাকে ভালোবেসেছিল, সেকথা ঠিক। আবার অনেকের কাছেই এই প্রবাসজীবন ছিল নেহাৎই নরকযন্ত্রণা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তৃপক্ষ স্বপ্ন তো দেখেছিল ভারত-জুড়ে সাম্রাজ্যের। কিন্তু তাতে প্রবাসযন্ত্রণা কম সইতে হয়নি। সাহেবদের ডেরা বাঁধার প্রথম যুগের সে যাতনা বাস্তবিকই মারাত্মক। একে তো লম্বা গ্রীষ্মকাল। সে ফ্যানি পার্কস যতই কালবৈশাখীর গুণগান করুন না কেন। ঘামে ভেজা আর্দ্র আবহাওয়া সাহেবদের কদাচিৎ মনোরম লাগত। প্রথম যুগে কাজকর্মও তেমন বেশি ছিল না। রাজনৈতিক উত্তেজনা ছিল, তবে তারও আঁচ এমনকিছু ছিল না। আঠেরো শতকের শুরুতে কলকাতায় সাহেবদের জনসংখ্যা আহামরি নয়। মেমসাহেবদের তো নয়ই। অবসর-বিনোদনের তেমন সুযোগ নেই। কিন্তু পকেটে পয়সা আছে। ব্রিটেনের চৌহদ্দি-পেরোনো সিভিলিয়ন স্বদেশের রীতকানুন বজায় রাখতে পারত না প্রবাসে। মদ ও আরো বেশকিছু নেশা, কুকর্মে জড়িয়ে পড়ত। প্রবাসজীবন তো নয়, যেন নির্বাসন। মেকলে তাই বাধ্য হয়েই লিখেছিলেন, '...banishment is no light matter. A complete revolution in all habits of life..."
সাহেবরা এদেশের রাজা হতে চেয়ে এদেশে প্রচলিত রাজকীয়তাকে প্রথমে আপন করেছিল। লাগামহীন খরচ। প্রচুর ভৃত্য-সমাবেশ। আর সুরা। একাকিত্ব, একঘেয়েমি ঘোচানোর সহজ রাস্তা। তাদের অপরিমিত মদ্যপান কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সমস্যায় ফেলত ঠিকই। আর শুধু যে তাতে ব্রিটিশ সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হত তা নয়। প্রাণহানি কম হত না মদ্যপানের দরুণ। পার্টিতে ডিনার খাওয়ার পর কেউ কেউ এত বেশি পরিমাণ ক্ল্যারেট পান করত যে আর চলার ক্ষমতা থাকত না। গৃহকর্তার বাড়ির মেঝেতে বা সোফায় গড়াগড়ি দিয়ে রাত কাটত। শরীর গরম হয়ে উঠত৷ জানলাদরজা সব খুলে দিলে উত্তর-পশ্চিমা শীতল বাতাসে ঘাম শুকোত ঠিকই। তারপর দেখা দিত জ্বর৷ আর মৃত্যু। মদের ফোয়ারা ছুটত সাহেবপাড়ার যত্রতত্র। ১৭৮৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে Monte de Carmo- নামে একটি জাহাজ লন্ডন থেকে কলকাতায় আসে। জাহাজে ঠাসা ছিল উনিশ রকমের সুরা। ফ্রেঞ্চ ক্ল্যারেট, মদেইরা উপচে পড়েছিল। ক্যালকাটা গেজেটসহ বেশকিছু সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল মদের - 'Dring and Company inform the public, that they have a very General and Extensive stock of Genuine Madeira Wine which they recommended to their Friends and Customers... '
আরও পড়ুন
নিজাম পরিবারের কন্যার প্রেমে ইংরেজ সাহেব, বদলে নিলেন নাম–পোশাকও
মদেইরা - খুবই কাঙ্ক্ষিত ছিল সাহেবদের কাছে। তবে সবসময় অর্থে কুলোত না। ধারদেনা করে ক্ল্যারেট বা মদেইরা পান করতে হত। আঠেরো শতকের শেষদিকে কলকাতায় বছরে চারহাজার পিপে মদেইরা বিক্রি হত। নেহাৎ কপর্দকশূন্য হলে অবশ্য হল্যান্ডের রাম, ব্র্যা ন্ডি দিয়ে কাজ চালাতে হত। স্যার ফিলিপ ফ্রান্সিস নাকি অতিথি আপ্যায়নের জন্যে একমাসে পঁচাত্তর বোতল মদেইরা, নিরানব্বই বোতল ক্ল্যারেট, চুয়াত্তর বোতল পোর্টার, ষোলো বোতল রাম, তিন বোতল ব্র্যালন্ডি, আর কয়েক বোতল শেরির আয়োজন করতেন। তাতে খরচ কী মারাত্মক হত, তা সহজেই অনুমেয়।
আরও পড়ুন
সাহেব মারার গুরুদায়িত্ব, হাতের মুঠোয় পেয়েও ব্যর্থ ‘গায়ক’ শিবরাম
শুধু তো লাগামহীন মদ্যপান নয়। সাহেবদের কুকাজের ঝুলিও ক্রমশ ভরে উঠছিল। বিদেশেও সেখবর পৌঁছেছিল। ১৭৫৫ সালে বিলেত থেকে চিঠি আসে কলকাতার কাউন্সিলরের কাছে। সিভিলিয়ানদের সংযত হওয়ার নির্দেশ আসে। কিন্তু বিষয়টা অত সহজ ছিল না। শিল্পবিপ্লবের পর ইউরোপের সামাজিক অবস্থা সম্পূর্ণ বদলে যায়। ভারতবর্ষসহ দক্ষিণ এশিয়া সোনার খনির মতোই হাতছানি দিতে থাকে। কার্যত হতও তাই। তুলনামূলক দরিদ্র ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারী হিসেবে ভারতে আসা ইস্তক প্রচুর ধনসম্পদের অধিকারী হত। অচেনা দেশ, তার ভূ-প্রকৃতি, সংস্কৃতি- সবই অনেক দূরের। ফাঁকা সময়ও প্রচুর। আর স্বদেশের মতো আইনকানুনও অত কড়া নয়। সাহেবদের জন্যে তো নয়ই। দু-আড়াইমাস জলপথে কাটানোর পরে ইংরেজ তরুণ ভৃত্য-পরিবৃত হয়ে প্রায় রাজা হয়ে বসত। হাতে ক্ষমতা, সম্পদ দুইয়েরই প্রাচুর্য। ফলত যাচ্ছেতাই করার সমূহ সুযোগ। ধারদেনা করে হলেও তারা মদিরায় বুঁদ হয়ে থাকত। বেহিসেবী বিলাসী জীবনে মৃত্যুও অতর্কিতে হানা দিত। আইন দিয়েও তা ঠেকানো যেত না।
আরও পড়ুন
ডাফ সাহেবের মুক্তচিন্তায় বিরক্ত রক্ষণশীল বাঙালি, জন্ম নিল নতুন শব্দ – ‘ডেঁপো’
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী বা উপরমহলের সাহেবসুবো ছাড়া গরিব সাহেবও কম ছিল না কলকাতায়। তারা অনেকেই জাহাজের কর্মচারী। সমুদ্রের দীর্ঘপথ, হাড়ভাঙা খাটুনির পর যেই বন্দরে ভিড়ত জাহাজ- শহরে ঢুকে পালিয়ে যেত তারা। কিছুতেই সেকাজে আর বহাল হত না। জাহাজও কিছুদিন পরে তাদের কলকাতায় ছেড়েই চলে যেত। অসুস্থ অর্ধোন্মাদ দরিদ্র সাহেব কলকাতায় এসে আরোই হাবুডুবু খেত। পকেটের সামান্য টাকাকড়ি দ্রুতই ফুরিয়ে যেত। সস্তার ট্যাভার্নে থেকে সস্তা পাঞ্চ মদ খেয়ে উড়ে যেত সেসব সহজেই। আর তারপরই হাতখালি। কলকাতাকে ঘিরে গুজব তো কম ছিল না। প্রচুর টাকা রোজগারের সুযোগ নাকি। কিন্তু এসব সাধারণ নিচুতলার কর্মচারীরা যে সে সম্পদের নাগাল পায় না - তা তাদের জানা ছিল না। ফলে পালিয়ে শহরে ঢুকে তো যাওয়া যায়। তারপরই স্বপ্নভঙ্গ। উঁচুতলার এলিট সাহেবমেমরা কিন্তু গরিব সাহেবদের মোটেই গুরুত্ব দিত না। ক্রমে ক্রমে তারা ট্যাভার্ন থেকে বিদায় নিত। ডাকাতি জুয়াচুরিতে নাম লেখাত। সস্তা মদে আকণ্ঠ ডুবে জপথে হল্লা জুড়ত। কলকাতা শহর হাঁ করে দেখত এসব ভবঘুরে সাহেবদের৷ স্বদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিদেশের রাস্তায় যাদের জীবন কাটছে। মূলত এই ভবঘুরে সাহেবদের জন্যই আঠেরো শতকে কলকাতায় প্রথম অ্যাসাইলাম তৈরি হয় ভবানীপুরে। দ্য ক্যালকাটা ল্যুনাটিক অ্যাসাইলাম। মনোচিকিৎসা সেখানে আদৌ হত কিনা জানা নেই। তবে হ্যাঁ, রাস্তা থেকে জঞ্জাল সাফের একটা চেষ্টা হত। বস্তুত, এই দরিদ্র, কপর্দকহীন সাহেবরা উঁচুমহলের স্বজাতি হতে পারত না, আবার এদেশের সাহেবত্ব এড়িয়ে এদেশকেও আপন করতে পারত না। নেশায় ডুবে ভবঘুরে হওয়া ছাড়া তাদের কীই বা উপায় থাকবে আর। অথচ তারা যেন ইংরেজের সাংস্কৃতিক নৈতিক ভাবমূর্তিতে বারবার কালি লেপে দেয়। তাদের মুছে ফেলা না যাক, রাস্তা থেকে সরানো তো যায়। অগত্যা ভবঘুরে সাহেবের গন্তব্য অ্যাসাইলাম।
একটা নতুন শহরে ঢের কিছু নতুন তৈরি হয়। প্রতিদিন তার রূপ বদলায়। চোখজুড়োনো ইমারত হয়। শহর নতুন ঠিকানা দেয়, আবার ঠিকানা কাড়েও। ঠিক তখনই মাথা ঝিমঝিম আর চোখে সর্ষেফুল দেখার ব্যঞ্জনা স্পষ্ট হয়।
(ঋণঃ সাহেবমেম সমাচার; কোম্পানির আমলে কলকাতা - নিখিল সুর)
Powered by Froala Editor