১৯৬৯ সাল। ২০ জুলাই। প্রথমবারের জন্য চন্দ্রপৃষ্ঠে পা দিল মানুষ। নীল আর্মস্ট্রং এবং এডুইন বাজ অলড্রিন। তৈরি হল এক নতুন ইতিহাস। তবে এই দুই ব্যক্তিত্বের পাশাপাশি সেই ইতিহাসের অংশীদার আরও একজন। মাইকেল কলিনস। অনালোচিত, বিস্মৃতপ্রায় একটি নাম। না সেদিন চাঁদের মাটিতে অবতরণ করেননি মাইকেল। বরং টানা ৮দিন ৪ ঘণ্টা সময় কাটিয়েছিলেন মুন-অরবাইটারে বসে। তিনি না থাকলে হয়তো অসম্পূর্ণ থেকে যেত নীল মানব সভ্যতার প্রথম বহির্বিশ্বজয়।
গত ২৮ এপ্রিল প্রয়াত হলেন কিংবদন্তি এই নভোচারী। বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। দীর্ঘদিন ধরেই ভুগছিলেন দুরারোগ্য ক্যানসারে। চন্দ্রজয় করলেও, মারণ রোগকে হারাতে পারলেন কই? ফুরল ইতিহাসের এক জীবন্ত অধ্যায়। গতকাল তাঁর মৃত্যুসংবাদ নিশ্চিত করে তাঁর পরিবার। সহকর্মীর প্রতি টুইটারে শ্রদ্ধা জানান বাজ অলড্রিনও। জানা যায়, ফ্লোরিডাতে নিজের বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন ‘লোনলিয়েস্ট ম্যান ইন হিস্ট্রি’ মাইকেল কলিনস।
মার্কিন নাগরিক হলেও কলিনসের জন্ম ইতালির রোমে। বাবা ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে ইতালিতে কর্মরত ছিলেন তিনি। সেই সূত্রেই কলিনসের বড়ো হয়ে ওঠা ইতালিতে। জীবনের প্রথম ১৭ বছর তিনি কাটিয়েছেন ইতালির বিভিন্ন শহরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক আগে ইতালি থেকে সেনা সরিয়ে নেয় যুক্তরাষ্ট্রে। সেইসময়েই মার্কিন প্রদেশে ফেরা কলিনসের।
মাত্র ১৫ বছর বয়সে প্রথম উড়ানের স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলেন কলিনস। বাবার সহকর্মীদের থেকে আয়ত্ত করেছিলেন বিমানচালনা। ইতালি ছাড়ার আগে ডুয়েল ইঞ্জিন উভচর এয়ারক্র্যাফট ‘গ্রুম্যান উডগন’-এর পাইলটের আসনে বসেছেন বেশ কয়েকবার। ১৯৫২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারি অ্যাকাডেমি থেকে ‘মিলিটারি সায়েন্স’-এ স্নাতকতা করেন কলিনস। তারপরই আনুষ্ঠানিকভাবে অভিষেক হয় পাইলটের আসনে। দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় মার্কিন সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন তিনি।
আরও পড়ুন
প্রয়াত অনীশ দেব, শেষ হল বাঙালির কল্পবিজ্ঞানচর্চার এক অধ্যায়
ষাটের দশকের শুরুর দিকে মহাকাশ অভিযানের প্রস্তুতি শুরু করে নাসা। খোঁজ শুরু হয় উপযুক্ত নভোচারীদের। শেষ পর্যন্ত মার্কিন বিমানবাহিনীর দক্ষ ৩১ জন পাইলটকে বেছে নেয় নাসা। সেই তালিকাতেই ছিলেন কলিনস। খামতি ছিল না উৎসাহে। ফলত আবার নতুন করে শুরু হল পড়াশোনা। এবার তিনি শান দিলেন সনাতন বিজ্ঞানে। দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে চলল পদার্থবিদ্যা, জিওলজির পাঠক্রম। সেইসঙ্গে ট্রেনিংও। কঠিন থেকে কঠিনতর প্রতিটি পরীক্ষাই সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন কলিনস। তারপরই সেই ঐতিহাসিক চন্দ্র অভিযান। অ্যাপোলো-১১।
আরও পড়ুন
কোভিডে আক্রান্ত হাথরাস-কাণ্ডে বন্দি সাংবাদিক, লড়ছেন মৃত্যুর সঙ্গে
এই অভিযানের দৌলতেই তিনি পরিচিতি পান ‘ইতিহাসের নিঃসঙ্গতম মানুষ’ হিসাবে। চন্দ্রপৃষ্ঠে নীল এবং অলড্রিন অবতরণ করলেও, অরবাইটারে থেকে যান কলিনস। সেখান থেকেই মডিউল নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করতেন তিনি। তবে খুব সহজ ছিল না সেই কাজ। চাঁদের অন্ধকারে অংশে চলে যাওয়া মাত্রই পৃথিবীর সঙ্গে সংযোগ ছিন্ন হয়ে যেত সম্পূর্ণভাবে। থাকত না নীল আর্মস্ট্রং কিংবা অলড্রিনের সঙ্গেও বেতারে যোগাযোগ করার সুযোগ। অন্ধকারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুধু প্রতীক্ষার মধ্যেই কাটিয়েছেন তিনি। সেই ঘটনাই এনে দেয় এমন পরিচিতি।
আরও পড়ুন
করোনায় প্রয়াত মানবতাবাদী নেতা মৌলানা ওয়াহিউদ্দিন খান
অ্যাপোলো অভিযানের সময়, মহাশূন্য থেকে তোলা পৃথিবীর ছবিগুলির পিছনেও রয়েছেন তিনিই। অরবাইটার বসেই তিনি লেন্স-বদ্ধ করেছিলেন নীলগ্রহ এবং চন্দ্রপৃষ্ঠের কয়েক হাজার ছবি।
ঐতিহাসিক সেই চন্দ্র-অভিযানের পর পেরিয়ে গেছে পাঁচ দশকেরও বেশি সময়। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার চাঁদের মাটিতে মানুষ পা দিলেও, ১৯৭২ সালের পর অধরাই থেকে গেছে উপগ্রহ-জয়। আগামী ২০২৪ সাএ আবার চাঁদের মাটি ছুঁতে চলেছে মানুষ। আরও এক ইতিহাস গড়তে চলেছে নাসা। কিন্তু তার আগেই বিদায় নিলেন পথিকৃৎ। পাড়ি দিলেন অনন্তের দিকে…
Powered by Froala Editor