প্রয়াত জ্ঞানপীঠ-জয়ী অহমিয়া কবি ও কথাসাহিত্যিক নীলমণি ফুকন

‘হে মোর সোপনর সূর্যর মানুহ…’

ম্লান হল সূর্যের তেজ। সন্ধ্যা নামল অহমিয়া তথা ভারতীয় সাহিত্যের বুকে। গত ৯ জানুয়ারির কথা। বিদায় নিয়েছিলেন কাশ্মীরের জ্ঞানপীঠ-জয়ী সাহিত্যিক আব্দুর রেহমান রাহি। সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই এবার অস্তমিত হল ভারতীয় সাহিত্যের আরও এক নক্ষত্র তথা জ্ঞানপীঠ-জয়ী অহমিয়া কবি নীলমণি ফুকন (Nilmani Phookan)। 

অবশ্য নীলমণি ফুকনকে শুধু কবি বা কথা-সাহিত্যিক বললে ভুল হয়। সম্পাদনা, রাজনীতি এবং শিক্ষকতা— প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরব উপস্থিতি ছিল তাঁর। দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত অসুখে ভুগছিলেন কিংবদন্তি কবি। সম্প্রতি তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় ভর্তি করা হয়েছিল স্থানীয় হাসপাতালে। আজ সকাল ১১টা ৫৫ মিনিটে সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ইতি পড়ে অহমিয়া সাহিত্যের একটি বর্ণময় অধ্যায়ে। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর।

১৯৩৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর। গোলাঘাট জেলার দেরগাঁও-তে জন্ম নীলমণি ফুকনের। গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাগের পর পা রাখেন শিক্ষকতার জগতে। ১৯৬৪ সালে গুয়াহাটির আর্য বিদ্যাপীঠ মহাবিদ্যালয়ে শুরু করেন অধ্যাপনা। অবশ্য তারও প্রায় এক দশক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল তাঁর সাহিত্যচর্চা। তৎকালীন সময়ে অহমিয়া সাহিত্যের এক ব্যতিক্রমী চরিত্র ছিলেন ছিলেন। 

আসলে তাঁর কলমে চিরকাল আধুনিক কবিতা জন্ম নিলেও, সেসব কবিতার ইমেজারিতে উঠে আসত অসমের ঐতিহ্যবাহী লোককথা, আঞ্চলিক ইতিহাস, প্রাচীন প্রবাদ, হারিয়ে যেতে বসা শব্দবন্ধ ও সাধারণ মানুষের জীবনের ছবি। বলতে গেলে আধুনিক এবং ধ্রুপদী সাহিত্যের মধ্যে যেন সেতুবন্ধনের দায়িত্ব পালন করেছেন নিজের অজান্তেই। 

ভারত তো বটেই, তাঁর হাত ধরে আন্তর্জাতিক পরিচিতি পেয়েছিল অহমিয়া সাহিত্য। একইভাবে অসমের পাঠকদেরও বহির্জগতের কবিতার সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিলেন তিনি। স্প্যানিস, জাপানি, চৈনিক— একাধিক ভাষার কবিতা অহমিয়ায় অনুবাদ করেছেন নীলমণি। উপস্থাপন করেছেন স্থানীয় পাঠকদের কাছে। যা পরবর্তীতে নতুন পথ দেখিয়েছে অহমিয়া সাহিত্যকে। বদলেছে তার গতিধারাকেও। 

১৯৮১ সালে স্বনির্বচিত কবিতা সংকলন ‘কবিতা’-র জন্য সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন নীলমণি। ১৯৯১ সালে পেয়েছিলেন পদ্মশ্রী এবং সাগনলাল জৈন পুরস্কার। ভূষিত হয়েছিলেন ‘কাব্য ঋষি’ ও ‘ডি লিট’ উপাধিতে। গত বছর পান ভারতের সাহিত্য জগতের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘জ্ঞানপীঠ’। উল্লেখ্য, বীরেন্দ্র ভট্টাচার্য এবং মামনি রাইসোম গোস্বামীর পর অসমের তৃতীয় জ্ঞানপীঠ-প্রাপক তিনিই। জ্ঞানপীঠ-প্রাপ্তির খবর পেয়ে মুখে সামান্য হাসি ফুটে উঠলেও, অশীতিপর কবির মুখে শোনা গিয়েছিল হতাশার সুর। কেন না, ততদিনে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার জন্য কলম ছাড়তে হয়েছে তাঁকে। কখনও কখনও বিশ্বাসঘাতকতা করছে স্মৃতিও। তবে অহমিয়া সাহিত্যজগৎ থেকে খালি হাতে বিদায় নেননি তিনি। বরং, সাহিত্যচর্চার এই ব্যাটন তুলে দিয়েছিলেন পরবর্তী প্রজন্মের তরুণ কবিদের হাতে। জানিয়েছিলেন, আগামীর সূর্যমানব তাঁরাই। বলতে গেলে, তাঁর প্রয়াণে যেন অভিভাবকহীন হল অহমিয়া সাহিত্য। হারাল জৌলুস। এমন এক দিকপালের মৃত্যুতে অসম তো বটেই, শোকস্তব্ধ গোটা দেশের সাহিত্যমহল… 

Powered by Froala Editor