উনিশ শতকের শেষদিক সেটা। দার্জিলিং-এর পর উত্তর-পূর্ব ভারতের পার্বত্য উপত্যকায় আরও একটি শহর তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে ব্রিটিশ সরকার। পাহাড় কেটে সেখানে তৈরি হবে সড়কপথ। বসবে রেল। গড়ে উঠবে চা-বাগান। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ তো বটেই, কাজের আশায় সেখানে ছুটলেন ভুটান, নেপাল, মায়ানমারের মানুষরাও। একাধিক সংস্কৃতি ও ভাষাভাষী মানুষের সহাবস্থানই সেসময় এক নতুন ভাষার জন্ম দিয়েছিল আসামের এই ছোট্ট পাহাড়ি শহর হাফলং-এ। যা পরিচিত ‘হাফলং হিন্দি’ (Haflong Hindi নামে। একশো তিরিশ বছর পর এবার মুছে যেতে বসেছে আসামের এই নিজস্ব হিন্দি।
হিন্দি বলা হলেও, হাফলং-এর ভাষার ব্যাকরণের সঙ্গে যথেষ্ট ফারাক রয়েছে হিন্দির। বরং, তিবেতো-বর্মান ভাষা পরিবারের ব্যাকরণকে অনুসরণ করে এই ভাষা। তবে এই ভাষার শব্দভাণ্ডারে হিন্দির পাশাপাশি রয়েছে নেপালি, নাগা, বর্মিজ, বাংলা, ইংরাজি-সহ একাধিক ভাষা। মিশেছে হামার, কুকি, জেমে (নাগা), বিয়াতে, ভাইফেই, হরাংখোল, খেলমা, রোংমেই-এর মতো স্থানীয় উপজাতি ভাষাও। জন্মের সময় মূলত শ্রমিক শ্রেণীর মানুষদের বসতি ছিল হাফলং। তাই অপরিবর্তিতভাবেই সেই সকল ভাষার শব্দ ঢুকে পড়েছে হাফলং হিন্দিতে। যার বিবর্তন হয়েছে সামান্যই। একইভাবে এই ভাষার কোনো লিখিত রূপও তৈরি হয়নি সেসময়।
এর পর কেটে গেছে প্রায় একশো বছর। বিশ শতকের শেষের দিক থেকে পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে হাফলং-এর জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে গোটা ভারতেই। একদিকে যেমন পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে সেখানে, তেমনই হাফলং-এ আস্তানা গেড়েছেন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবসায়ীরাও। তবে শতাব্দীপ্রাচীন এই কথ্য ভাষার ইতিহাস তাঁদের অধিকাংশের কাছেই অজানা। ফলে, এই ভাষাকে ভুল বা বিকৃত হিন্দি হিসাবেই চিহ্নিত করেন তাঁরা। চেষ্টা করেন সংশোধনের। এভাবেই যেন ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে ‘হাফলং হিন্দি’।
সম্প্রতি এই ভাষাকে আরও বিপন্নতার দিকে ঠেলে দিয়েছে কেন্দ্রের শিক্ষানীতি। ৯০-এর দশকের গোড়ায় উত্তর কাছাড় হিলস স্বায়ত্তশাসিত কাউন্সিলের শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্তর্গত করা হয়েছিল ‘হাফলং হিন্দি’। স্থানীয় শিশুদের শিক্ষাদানের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হত এই ভাষা। তবে কেন্দ্র বদল এনেছে এই নীতিতে। উত্তর এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের সর্বত্রই হিন্দি ভাষায় শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ‘হিন্দি’-র সনাতনী ফর্মটিকেই। ফলে, স্থানীয় স্কুলে পড়ানোর সময়ও ব্যবহৃত হচ্ছে সনাতনী হিন্দি ভাষা। সেক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্মের কাছে একপ্রকার অজানাই থেকে যাচ্ছে এই ভাষার ইতিহাস, বৈচিত্র এবং ব্যাকরণগত ব্যবহার।
চার দশক আগে স্থানীয় ভাষাবিদ তথা শিক্ষক সোমনাথ উপাধ্যায় ‘হাফলং হিন্দি’-র একটি বিশেষ শব্দকোষ রচনা করেন। বর্তমানে সেই গ্রন্থও প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে আসাম থেকে। হারিয়েছে শিক্ষাবিদ ভ্যানলাল বাপুই-এর লিখিত ‘হাফলং হিন্দি’-র ঐতিহাসিক নথিও। তবে এত কিছুর পরেও কেন্দ্র বা রাজ্য প্রশাসন কেউ-ই এগিয়ে আসেনি শতাব্দীপ্রাচীন ভাষাটির সংরক্ষণের জন্য। প্রশ্ন থেকে যায়, এভাবেই কি একটি কথ্য ভাষার মৃত্যু নীরবেই পর্যবেক্ষণ করবে ভারত? জানা নেই উত্তর…
Powered by Froala Editor