গুপ্তচর সন্দেহে জেলবন্দি; ’৬২-র যুদ্ধে যেভাবে ‘বেঁচে’ ছিলেন অসমের চা-বাগানের কুলিরা

ব্রিটিশ আর্টিলারি ইউনিটের মেজর রবার্ট ব্রুস যেদিন আসাম-অরুণাচল সীমান্তে সিংফো রাজত্বে পা রাখলেন, সেদিন স্থানীয় বাসিন্দারা অতিথির আপ্যায়ন করতে নিয়ে এসেছিলেন ফালাপ নামের একটি পানীয়। মেজর মুখে ছুঁয়েই জাত চিনতে পেরেছিলেন। এই পানীয় আর কিছুই না, চিনের বিখ্যাত পানীয় চা। অবশ্য কোম্পানির কাছে এই কথা প্রমাণ করতে বেশ কিছুদিন লেগে গেল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কর্তারা বুঝতে পারলেন। অসমের বুকে গড়ে উঠল চা বাগান। কিন্তু বাগান তো হল, অথচ গাছের পরিচর্যা করতে পারে এমন শ্রমিক পাওয়া তো দুষ্কর। তাই চিন দেশ থেকে জাহাজ ভর্তি করে কুলি নিয়ে আসা হল। তাঁদের কেউ কেউ চলে গেলেন উত্তর-বঙ্গের দিকে। আর বাকিরা উজানি আসামে।

পরবর্তীকালে অবশ্য চিন থেকে শ্রমিক নিয়ে আসা বন্ধ হয়ে যায়। স্থানীয় উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়েই গড়ে তোলা হয় 'বাগানিয়া' সমাজ। আর চিন থেকে আসা মানুষগুলোও ততদিনে চিনা কম, বাগানিয়াই হয়ে উঠেছিলেন বেশি। কোথাও চিনা ছেলে বিয়ে করেছে অসমিয়া মেয়েকে, আবার কোথাও চিনা মেয়ে দিব্যি ঘরকন্না করেছে অসমিয়া পরিবারে। এমনি করে যে কতগুলো দিন কেটে গেল, তার হিসাব করেননি কেউই। তবে ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে গিয়েছে একটা একটা করে। সারা দেশজুড়ে প্রতিরোধ তৈরি করে অবশেষে ব্রিটিশদের তাড়িয়ে স্বাধীন হয়েছে ভারত। চা বাগানের ইংরেজ মালিকরা অবশ্য থেকেই গেলেন। কিন্তু কুলিদের জীবন কি বদলায়নি একটুও? কে জানে!

যা বদলায়নি, তা হল চিনা-অসমিয়া সম্পর্ক। ভারতের স্বাধীনতায় একজন অসমিয়ার মতোই আনন্দিত হয়ে ওঠেন একজন চিনা কুলি। কোথায় হয়তো মনে পড়ে যায় তাঁর পিতৃভূমির কথা। সেখানেও তো তখন চলছে জাপ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই। তবে দিনে দিনে তাঁরাও এই দেশকেই স্বদেশ বলে চিনে নিয়েছিলেন। তাঁদের পরিচয় ছিল অসমিয়া-চিনা।

স্বাধীনতার পরেও এই মানুষদের বিদেশি বলে মনে করেননি কেউই। কিন্তু এক লহমায় পরিস্থিতি বদলে গেল ১৯৬২ সালে। চিনের তিব্বত অধিকার, দলাই লামা ভারতে আশ্রয় ভিক্ষা বা ভারত-চিন যুদ্ধের ব্যাপারে সম্যক ধারণা করতে পারেননি অনেকেই। শুধু প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর আশ্বাসবাণীই ছিল তাঁদের ভরসা। কিন্তু এর মধ্যেই আশেপাশের মানুষগুলোর দৃষ্টি যেন বদলে যাচ্ছিল একটু একটু করে। আর সেই দৃষ্টির সঙ্গে নিজেদের পরিচয় থেকে অসমিয়া শব্দটাই যেন কোথায় বাদ চলে গেল। প্রত্যেকেই হঠাৎ পরিচিত হয়ে উঠলেন চিনা বলে। অথচ সেদেশের ভাষাই হয়তো ভুলে গিয়েছেন কেউ কেউ। কারোর কারোর কাছে আছে অচল কুয়োমিনতাং পাসপোর্ট। কারোর কাছে সেটাও নেই। আক্ষরিক অর্থেই স্টেটলেস সেই মানুষগুলো কিন্তু তখনও আশায় বুক বেঁধে আছেন।

আরও পড়ুন
‘অপরাধ’ চিনে জন্মগ্রহণ করা, ’৬২-র যুদ্ধে গুপ্তচর সন্দেহে বন্দি ৩০০০ চিনা-ভারতীয়

কিন্তু ওদিকে চিনা বাহিনী যতই এগিয়ে আসতে থাকে, পরিস্থিতি ততই জটিল হয়ে উঠতে থাকে। তার মধ্যেই শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। আর কীভাবে যেন রটে গেল, এই মানুষগুলো যুদ্ধে চিনের গুপ্তচর। সত্যিই কি বিচিত্র এদেশের মানুষ আর তাদের মন। এরপর একদিন এল পুলিশ। এসে জানাল, নিরাপত্তার স্বার্থেই তিন-চারদিন অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হবে চিনা বংশোদ্ভূত মানুষদের। চা বাগানের ইংরেজ মালিকরা অবশ্য আপত্তি করেছিল। কিন্তু পুলিশের কাছে ছিল রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার পরোয়ানা। শেষ পর্যন্ত মুরলী গোলা গুদামঘর থেকে ঠিকানা হল ডিব্রুগড় জেল। আর তিন-চারদিন হয়ে গেল তিন-চার বছর।

আরও পড়ুন
৫০ বছর ধরে চিন থেকে সম্প্রচারিত হচ্ছে বাংলা সংবাদ, বেজে ওঠে রবীন্দ্রসঙ্গীতও!

অবশেষে একদিন সীমান্তে যুদ্ধের শব্দ থেমে গেল। মুক্তি পেলেন বন্দিরা। কিন্তু ভারতে তাঁরা যে বড্ড ব্রাত্য হয়ে উঠেছেন ততদিনে। অবশ্য অপমান সহ্য করে থেকে গেলেন অনেকেই। এটাই যে ততদিনে তাঁদের দেশ হয়ে উঠেছে। আবার কেউ কেউ মনে করলেন চিনে ফিরে যাবেন। সীমান্ত পেরিয়ে রওয়ানাও হলেন। কিন্তু সেখানেও তাঁদের ভালোভাবে গ্রহণ করলেন না কেউই। সীমান্তের একপারে তাঁদের পরিচয় ভারতীয়, অন্যপারে চিনা। আর আজ আবার দিগন্তে সিঁদুরে মেঘ দেখা দিয়েছে। মনের মধ্যে কোথায় যেন উঁকি দিচ্ছে ৫৮ বছর আগের সেই মর্মান্তিক দিনগুলো।

আরও পড়ুন
২৪২ বছর আগে বাংলায় চিনা উপনিবেশ, অধরাই রইল ‘দ্বিতীয় কলকাতা’ তৈরির পরিকল্পনা

তথ্যঋণঃ ‘দরকারে পাঠিয়ে দাও জেলখানায়, বিচ্ছিন্ন করে দাও অসমিয়া-চিনাদের পরিবারগুলিকে’, রাজীবাক্ষ রক্ষিত, আনন্দবাজার পত্রিকা

আরও পড়ুন
অভিযাত্রী গালওয়ানের নামেই নামকরণ উপত্যকার, নিজেও সাক্ষী ছিলেন চিনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের

Powered by Froala Editor

More From Author See More