ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, যার বাংলা অর্থ, ‘কোনো প্রশ্নই বোকা নয়’। শুধু উত্তর মেলে না বলেই প্রশ্ন কঠিন মনে হয়। এখন অবশ্য ইন্টারনেট (Internet) আছে, যে কোনো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য তৈরি থাকে গুগল। ফেসবুকের গ্রুপগুলিতেও চলে প্রশ্নোত্তরের পালা। মোট কথা, ইন্টারনেটের আগমন আমাদের জ্ঞানের খিদে বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু তার আগে? মানে যখন হাতের মুঠোয় পাওয়া যেত না উত্তর। লাইব্রেরিতে (Library) বইপত্র ঘেঁটে কিংবা কর্তৃপক্ষকে হাজারো প্রশ্নে জেরবার করে তবে আশ মিটত মনের। তখন ঠিক কী কী প্রশ্নের মুখে পড়তে হত লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষকে?
নিউ ইয়র্কের পাবলিক লাইব্রেরিতে (New York Public Library) ছিল এরকমই এক ব্যবস্থা। ১৯৬৭ সালে ‘লাইব্রেরিয়ানকে প্রশ্ন করুন’ (Ask a librarian) বলে একটি বিশেষ বিভাগ চালু করে তারা। ফোন করে কিংবা নিজে এসে জিজ্ঞেস করতে হত অজানা উত্তর। এখনও চালু আছে সেই ব্যবস্থা। সোম থেকে শনি, সকাল ৯টা থেকে সন্ধে ৬টা পর্যন্ত আপনার প্রশ্নের অপেক্ষায় বসে থাকবেন গ্রন্থাগারের আধিকারিক। হাতের কাছে প্রশ্নের উত্তর থাকতেও প্রতিবছর প্রায় ত্রিশ হাজার বার বেজে ওঠে টেলিফোনটি। কিন্তু প্রথমদিকে ফোন করা ব্যাপারটি এত সহজ ছিল না, তাই প্রশ্নকর্তাকেই আসতে হত লাইব্রেরিতে। একটা চিরকুটে প্রশ্ন লিখে অপেক্ষা করত হত লাইব্রেরিয়ানের উত্তরের। কয়েক বছর আগে ওই লাইব্রেরির কর্মচারীরা একটি বাক্স খুঁজে পান, যার ভিতরে গিজগিজ করছে উর্বর মস্তিষ্কের প্রশ্নের দল। যা দেখে হয় ‘বোকা প্রশ্ন’-এর ধারণা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে, কিংবা খুলে যেতে পারে আরো অসংখ্য প্রশ্নের দরজা।
উদাহরণ দেওয়া যাক কয়েকটি। ১৯৪৭ সালের একটি প্রশ্ন, হাতি আমাকে ধাওয়া করেছে, এই স্বপ্নের অর্থ কী? পরের বছরে একজন জানতে চেয়েছেন প্রতিটি দেশের আলাদা-আলাদা রঙের নমুনা। না, পতাকার রং নয়। হার্ভার্ড যদি লাল হয় আর ইয়েল যদি নীল, তাহলে ফ্রান্সের রং কী হবে? ১৯৪৯-এ একজন টেলিফোন করে জানতে চান যে তিনি সারাদিনে কতটা জল ব্যবহার করেন? ওই বছরের আরেকটি প্রশ্ন, একটা বিষাক্ত সাপ যদি নিজেকে কামড়ায়, তাহলে কি সেটি মারা যাবে? পরের কোনো এক বছরে ফোন করে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন এক ব্যক্তি। তাঁর কাছে বড়ো কাগজ আছে, আঠা আছে। কাগজটি তিনি দেওয়ালে আঁটকাবেন। কিন্তু বুঝতে পারছেন না আঠা কাগজে লাগাবেন, নাকি দেওয়ালে লাগাবেন। তাই তিনি শরণাপন্ন হয়েছেন লাইব্রেরির। আরেকজন জানতে চেয়েছেন, স্নাতক হওয়ার পর যে সবাই আকাশে টুপি ছুঁড়ে দেয়, সেটা কি আদৌ ফিরে আসে? ১৯৬২ সালে লাইব্রেরিতে এসে বই খুঁজছিলেন এক ব্যক্তি। বইটি হল চার্লস ডারউইনের লেখা ‘অরেঞ্জ ও পিচেস’। লাইব্রেরিয়ান অবশ্য বিনয়ের সঙ্গে তাঁকে ‘অরিজিন অফ স্পিসিস’ বইটি এনে দেন। বেশ কয়েক বছর পরে একজন জানতে চেয়েছেন আঠারো শতকের চিত্রগুলিতে কাঠবিড়ালির এত বাড়বাড়ন্ত কেন? তারা যাতে কামড়ে না দেয়, তার জন্য শিল্পীরা কী ব্যবস্থা নিতেন?
অবশ্যই হাস্যকর সব প্রশ্ন। তার মধ্যে কয়েকটি অদ্ভুত প্রশ্ন ছিল, যা কিন্তু রীতিমতো জোগাতে পারে চিন্তার রসদ। ১৯৪৪ সালে একজন জানতে চেয়েছেন ভালো কবিতা কোনটা? যেখানে প্রতি পংক্তিতে অন্ত্যমিল থাকবে, নাকি একটি ছেড়ে পরের পংক্তির সঙ্গে যেখানে অন্ত্যমিল থাকবে? এভাবে যে ভালো কবিতার সংজ্ঞা নির্ধারণ করা যায় না, সেটা নিয়ে নতুন করে কিছু করার বলার নেই। কিন্তু আজও বহু মানুষের মুখে শোনা যায় কবিতায় অন্ত্যমিল হারিয়ে যাওয়ার দুঃখ। ১৯৫০ সালের একটি প্রশ্নে বলা হয়েছে, ১৮৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের আগে শেষ কবে পূর্ণিমার চাঁদ দেখা যায়নি? হয়তো প্রশ্নটা অন্যরকমভাবে করতে চেয়েছিলেন তিনি। প্রতি ১৯ বছর অন্তর ফেব্রুয়ারি মাসে সত্যিই পূর্ণিমার চাঁদ দেখা যায় না। যাকে বলা হয় ব্ল্যাক মুন। সেক্ষেত্রে জানুয়ারি বা মার্চে পূর্ণিমা হয় দু’বার। তাই সঠিক উত্তরটি হবে ১৮৪৭। লাইব্রেরিয়ান এ প্রসঙ্গে কী উত্তর দিয়েছিলেন জানা নেই। তবে বিষয়টি যে ওই পাঠককে ভাবিয়েছিল সেটা নিশ্চিত।
আরও পড়ুন
বই নয়, এই লাইব্রেরিতে ভাড়া পাওয়া যায় গৃহস্থের ব্যবহারিক সামগ্রী!
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, এরকম ‘বোকা’ প্রশ্ন কেন? খালি চোখে হয়তো তাই মনে হয়, তবুও সারাদিনে কতটা জল প্রয়োজন কিংবা স্বপ্নের ব্যাখ্যা ভাবিয়েছে কাউকে না কাউকে। অনেকের মতে, এই প্রশ্নের পিছনে লুকিয়ে তীব্র একাকিত্ব। কথা বলার মানুষ নেই জীবনে, তাই লাইব্রেরিতে ফোন করে দুটো কথা বলার সুযোগ খুঁজে নিয়েছে মানুষ। সে জানে, যাই জিজ্ঞেস করা হোক না কেন, এখানে তাকে ফেরাবে না।
আরও পড়ুন
কখনও উটের পিঠে, কখনও যুদ্ধযানে— পৃথিবীর আশ্চর্য কিছু ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির গল্প
এসব তো নাহয় ষাট-সত্তর বছর আগেকার মানুষের কথা। এখন আর জনসমক্ষে এসব প্রশ্ন করে নিশ্চয়ই বোকা হতে চাইবে না কেউ। কিন্তু মোবাইলের ‘সার্চ হিস্টরি’ ঘাঁটলে দেখা মিলবে মণি-মুক্তোর মতো এরকম প্রশ্নের। পুরনো লোকেরা তবু শোনা খবরকে যাচাই করে দেখতে লাইব্রেরিকে বিরক্ত করতেন, আর এখন ভুয়ো খবরকে বিশ্বাস করেই চলছে জীবনযাপন। তারচেয়ে ‘বোকা’ প্রশ্নরা তো অনেক ভালো। আরো অনেক কাল বেঁচে থাকুক তারা।
Powered by Froala Editor