শিল্প-সাহিত্য বলুন, বা খেলা, বাংলায় প্রতিভার অভাব কোনোকালেই ছিল না। কেউ কেউ বেঁচে থাকার সময়ই প্রবল সম্মান পেয়ে গেছেন, কেউ বা মৃত্যুর পর। কাজেই শতবর্ষ, সার্ধশতবর্ষের ছড়াছড়ি এখানে। অবশ্য ঠিকমতো দেখতে গেলে, ওই মানুষগুলোর কীর্তির কাছে আমরা সবাই ঋণী। যেমন ধরুন বাংলা সাহিত্য। এমনিতেই কবিতা-প্রবণ জাত বলে বাঙালিদের খানিক ‘বদনাম’ আছে। সেই কবে থেকে এত বিশাল সংখ্যক সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে এই বঙ্গদেশে। এখনও হয়েই চলেছে। সেসবকে একসঙ্গে আনাও তো চাট্টিখানি কথা না! সেই কাজটাই বিংশ শতকে করে গিয়েছিলেন যিনি, সেই অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের শতবর্ষ চলে এল বাংলায়; খানিক নীরবেই…
১৯২০ সালে চব্বিশ পরগণার বনগাঁয় জন্মালেও, পাঁচ বছর বয়স থেকে তাঁর বাস হাওড়ায়। ছোটো থেকেই তুখোড় ছিলেন পড়াশোনায়। বেশিরভাগ জায়গাতেই প্রথম স্থানটি ছিল বাঁধা। যেমন ছিল মেধা, তেমনই তাঁর স্মৃতিশক্তি ও গবেষণার নিরলস খিদে। জীবনের শেষ লগ্ন পর্যন্ত এই দুটোই ছিল তাঁর দুই স্তম্ভ। নিজের সময় আইএ পরীক্ষায় কেবল বাংলা নয়, আসামের পরীক্ষার্থীদের মধ্যেও প্রথম হন তিনি। এমন ছাত্ররা সাধারণত প্রবল রাশভারী, সিরিয়াস গোছের একজন হন, প্রচলিত ধারণা এটাই। তবে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এই পথের পথিক ছিলেন না। বাস্তব জীবনে যেমন ছিলেন ছাত্রদরদী, তেমনই ছিলেন রসিক।
অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা আসলে আরও একটি বইয়ের নাম চলে আসবে— ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’। নয় খণ্ডে প্রকাশিত এই বিশাল কাজ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। গবেষণার কাজে এতটুকুও ফাঁকি দেননি তিনি। অধ্যাপনার কাজ সামলে বারবার ছুটেছেন লাইব্রেরিতে। আজও যে কোনো গবেষক এবং পড়ুয়াদের কাছে এই বইগুলি অমূল্য সম্পদ। তবে অসিতবাবুর সাহিত্যকীর্তির নমুনা এখানেই শেষ হয় না। কলেজের ছাত্র থাকার সময় থেকেই অনুবাদের কাজ শুরু করেন তিনি। তাঁর লেখা দেশ, নবশক্তি-সহ নানা পত্রিকাতেও প্রকাশ করা হত। তবে বাংলা সাহিত্য ও তার ইতিহাস নিয়েই তাঁর যাবতীয় কাজ।
লেখা, গবেষণার পাশাপাশি অধ্যাপনার ভূমিকাতেও অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় চিরস্মরণীয়। হাওড়া গার্লস কলেজ, নবদ্বীপের বিদ্যাসাগর কলেজ ও পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়— যেখানেই গেছেন নিজের পরিচয় রেখে গেছেন। হাওড়া গার্লস কলেজে থাকাকালীন তাঁর সহকর্মী ছিলেন স্বয়ং জীবনানন্দ দাশ। সেই সময় বেশ কাছ থেকে দেখেছেন কবিকে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অধ্যাপক’-এর পদও অলঙ্কৃত করেছিলেন। আজও তাঁর সুযোগ্য ছাত্ররা স্মরণ করেন তাঁদের প্রিয় অধ্যাপককে। আর করবেন নাই বা কেন! যেমন ছিলেন নিজের পড়াশোনায় সিরিয়াস, তেমনই ছিলেন ছাত্রদরদী। কারোর যদি খরচের অসুবিধা হত, এগিয়ে আসতেন তিনি। নিজের বাড়ি থেকে বই দিয়ে দিতেন পড়ার জন্য। ছাত্ররাই যে তাঁর ‘অ্যাসেট’, সে কথা বারবার বলতেন।
সারাজীবন হাওড়ায় থেকেছেন। তা নিয়ে গর্বও ছিল প্রচণ্ড। কলকাতা, হাওড়ার দূষণ নিয়ে চলত অহরহ রসিকতা। বাঙালিদের শতবর্ষ উদযাপন নিয়েও রসিকতা করতে ছাড়েননি। সব মিলিয়ে জীবনটাকে উপভোগ করেছেন প্রাণভরে। বাংলা ভাষার গন্ধ, শব্দ ধারণ করেছিলেন নিজের ভেতর। ২০০২ সালে অন্নদাশঙ্কর রায়ের পর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অ্যাকাডেমির সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন। এছাড়াও ছিলেন এশিয়াটিক সোসাইটির ‘বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গবেষক’। শেষ বয়সে এসে নানা সম্মান পেয়েছিলেন। তার থেকেও বড়ো ছিল অগুনতি ছাত্রছাত্রীরা, যারা সর্বক্ষণ আঁকড়ে থাকতেন তাঁদের প্রিয় অধ্যাপককে। আজ এই শতবর্ষের মধ্যে তাই আরও একবার স্মরণ করে নেওয়া অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
তথ্যঋণ—
১) আনন্দবাজার পত্রিকা
২) ‘জীবনানন্দ দাশ’/ মহীতোষ বিশ্বাস
Powered by Froala Editor