‘উত্তমের মাপের অভিনেতা সারা পৃথিবীতে খুব কম এসেছে। বড্ড তাড়াতাড়ি চলে গেল। ও থাকলে আমি হয়তো আরও কিছু ছবির করার কথা ভাবতাম।’ মহানায়কের চলে যাওয়ার অনেক বছর পরেও এই কথাগুলো বলেছিলেন তাঁর চারটি জনপ্রিয় ছবির (‘নিশিপদ্ম’, ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘মৌচাক’ ও ‘অগ্নীশ্বর’) পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়। টালিগঞ্জ স্টুডিও পাড়ায় তিনি ঢুলুদা নামেই বেশি পরিচিত। উত্তমবাবু প্রয়াত হন মাত্র ৫৪ বছর বয়সে, ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই। আর দীর্ঘায়ু অরবিন্দবাবু শতবর্ষ ছোঁয়ার তিন বছর আগে, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬-তে চলে যান।
প্রয়াণের প্রায় ৪০ বছর পরেও উত্তমকুমারের জনপ্রিয়তায় এতটুকু ভাঁটা পড়েনি। আর অরবিন্দবাবুকে বাংলা চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষ কতটা ভালোবাসেন তার প্রমাণ গত বছর তাঁর জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানে নন্দন প্রেক্ষাগৃহে উপছে পড়া ভিড়ে। সেদিন হলভর্তি দর্শকের উপস্থিতিতে আর একবার দেখানো হয়েছিল ‘অগ্নীশ্বর’ ছবিটি। উপস্থিত ছিলেন ছবির নায়িকা মাধবী মুখোপাধ্যায়-সহ বিশিষ্টজনেরা। মাধবী শুনিয়েছিলেন ‘অগ্নীশ্বর’ ছবির শুটিংয়ের নানা ঘটনা এবং উত্তম-অরবিন্দ হৃদ্যতা নিয়ে কিছু কথা। মহানায়কের প্রয়াণমাসে ফিরে দেখি এই দুই বিশিষ্ট মানুষের পারস্পরিক শ্রদ্ধা ভালোবাসার কয়েকটি স্মরণীয় মুহূর্ত।
অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় যখন নিউ থিয়েটার্সে বিমল রায়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট তখন বিমলবাবু তাঁর হিন্দি ছবি ‘পহেলা আদমি’তে নায়কের জন্য নতুন ছেলে খুঁজছিলেন। সুযোগের আশায় অনেকের মতো উত্তমও গিয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচিত হননি। তাঁর হিন্দি উচ্চারণের সমস্যা ছিল। সেখানেই আলাপ হয়েছিল অরবিন্দবাবুর সঙ্গে। সেই আলাপ ক্রমশ বন্ধুত্বে পরিণত হয়। অরবিন্দবাবু বয়সে উত্তমবাবুর চেয়ে বছর সাতেকের বড়ো। তাই উত্তম ওঁকে ঢুলুদা বলেই ডাকতেন। উত্তমকুমারের বাবা ছিলেন মেট্রো সিনেমা হলের চিফ অপারেটর। বাবার এনে দেওয়া পাসে তিনি আর ঢুলুদা সিনেমা দেখে বেরিয়ে রাতের গড়ের মাঠে বসে ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্নের জাল বুনতেন। পোর্ট কমিশনার্সে চাকরি করা অরুণ চট্টোপাধ্যায়ের (তখন উত্তমকুমার হননি) চোখে তখন অসিতবরণের মতো নায়ক হওয়ার স্বপ্ন আর অরবিন্দবাবু তখন বিমল রায়ের মতো পরিচালক হওয়ার জন্য স্টুডিয়ো পাড়ায় ঘাম ঝরাচ্ছেন। অবশেষে উত্তম সুযোগ পেলেন ১৯৪৮ সালে নীতিন বসুর ‘দৃষ্টিদান’ ছবিতে অসিতবরণের ছোটোবেলার রোলে। আর অরবিন্দবাবুর স্বাধীনভাবে প্রথম ছবি করার সুযোগ এল ১৯৫৯ সালে এম পি স্টুডিয়োর ব্যানারে ‘কিছুক্ষণ’।
অরবিন্দবাবু ভেবেছিলেন প্রথম ছবিতেই উত্তমকে নেবেন নায়ক হিসাবে। কিন্তু এম পি স্টুডিয়োর কর্ণধার মুরলীধর চট্টোপাধ্যায়ের পরামর্শে উত্তমকে না নিয়ে অসীমকুমারকে নায়ক করলেন। মুরলীধরবাবু নবীন পরিচালককে বলেছিলেন, ‘এটা তোমার প্রথম ছবি। যদি হিট হয়, সমস্ত ক্রেডিট যাবে উত্তমের দিকে। ফ্লপ হলে লোকে বলবে তোমার ডিসক্রেডিট।’ বড়দা বনফুলের (বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়) লেখা গল্প নিয়ে তৈরি এই ছবি অসাধারণ সাফল্য লাভ করেছিল এবং রাষ্ট্রপতি পুরস্কারের জন্য মনোনীতও হয়েছিল।
এরপর অনেকটা সময়, অনেক কঠিন লড়াই পার হয়ে উত্তমকুমার বাংলা ছবির জনপ্রিয়তম নায়ক, নায়ক থেকে মহানায়ক। আর ততদিনে অরবিন্দবাবুও অনেকগুলো হিট ছবির সফল পরিচালকের আসনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ১৯৭০ সালে প্রথম দু’জনে একসঙ্গে কাজ করলেন ‘নিশিপদ্ম’ ছবিতে। সম্ভবত, এই ছবিতেই প্রথম উত্তমকে নায়কের ইমেজ থেকে বার করে ক্যারেক্টার রোলে হাজির করলেন অরবিন্দবাবু। গানে, গল্পে, অভিনয়ে ছবি সুপারহিট। রজত জয়ন্তী পার করেছিল এই ছবিটি। ছবিতে গান গেয়ে মান্না দে এবং সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। এরপর একে একে হল ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘মৌচাক’ এবং সর্বশেষ ‘অগ্নীশ্বর’। সবক’টি ছবিতেই উত্তমকুমারের ক্যারেক্টার রোল যা আজও দর্শককে মুগ্ধ করে। ‘অগ্নীশ্বর’ উত্তম অভিনীত ছবিগুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা ছবি। অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের কাছেই শোনা, ‘উত্তম ‘অগ্নীশ্বর’-এর জন্য প্রচুর পরিশ্রম করেছিলেন। একদিন তো সারাদিন ধরে একটি শটের জন্য তিনি শুটিং করেছিলেন। কিছুতেই শট তাঁর মনোমতো হচ্ছিল না। তারপর রাত্রিবেলা শট দিয়ে সন্তুষ্ট হলেন। উত্তমকে বলেছিলাম, আজ থাক, কাল দেবে। উত্তম বলেছিল, “না ঢুলুদা, আজই শট শেষ করে তারপর বেরোব স্টুডিয়ো থেকে।” এতটাই সিরিয়াস ছিল। তার ওপর সেদিন ছিল ওর জন্মদিন। ও সব ভুলে গেছিল। ‘অগ্নীশ্বর’-এ খুব ভাল কাজ করেছিল। মনেই হয়নি ও ডাক্তার নয়।’
এবার না-হওয়া তিনটি ছবির কথা বলে শেষ করি। ‘পিতাপুত্র’ ছবিতে নায়কের জন্য উত্তমের কথাই ভেবেছিলেন অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়। কিন্তু উত্তম ডেট দিতে না পেরে নিজেই স্বরূপ দত্তর নাম সাজেস্ট করেন। ‘মন্ত্রমুগ্ধ’ ছবির জন্য উত্তমের নাম ঠিক হল। স্ক্রিপ্ট পড়ার দিন তিনি আসতে পারেননি, কোনও খবরও দেননি। প্রযোজক ক্ষুণ্ণ হয়ে পরিচালককে বললেন, আপনি অন্য কাউকে নিন, আমি আপনাকে দেখে ছবি করতে এসেছি, উত্তমবাবুকে দেখে নয়। এই সম্মানের মর্যাদা দিতে অরবিন্দবাবু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে নিলেন নায়কের চরিত্রে। এই ঘটনার প্রভাবে দু'জনের সম্পর্ক কোনোদিন খারাপ হয়নি। এমনও হয়েছে বিজয়ার পর রাস্তায় প্রিয় ঢুলুদাকে দেখে উত্তমকুমার গাড়ি থেকে নেমে এসে পা ছুঁয়ে প্রণাম করেছেন। সমরেশ বসুর ‘নাটের গুরু’ গল্পটা উত্তম-সুচিত্রাকে নায়ক-নায়িকা করে ছবি করার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন অরবিন্দবাবু। কিন্ত উত্তমকুমারের অকালপ্রয়াণে তা থেমে যায়।
আরও পড়ুন
সদ্যপ্রয়াত বাবার ইজিচেয়ারে ছবি বিশ্বাসকে বসতে অনুরোধ করলেন উত্তমকুমার
বর্তমান প্রতিবেদকের সৌভাগ্য হয়েছিল অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের সান্নিধ্যে আসার। নব্বই উত্তীর্ণ বয়সেও তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল কাচের মতো স্বচ্ছ। পুরোনো দিনের অনেক কথাই গল্পচ্ছলে বলতেন। উত্তমকুমারের প্রসঙ্গ এলে দেখতে পেতাম এক উচ্ছ্বলতা। উত্তমকুমারের অকালে চলে যাওয়াটা অরবিন্দবাবুকে খুব মর্মাহত করেছিল। বলতেন, ‘উত্তমের মতো ডেডিকেশন খুব কম অভিনেতার মধ্যে দেখেছি। দুশো পঁচাত্তর টাকা মাইনের সাধারণ কেরানি থেকে নায়ক, নায়ক থেকে মহানায়ক হয়ে ওঠার পিছনে ছিল ওর কঠিন অধ্যাবসায়, অদম্য জিদ আর শিখরে পৌঁছানোর অবিচল লক্ষ্য। ‘অগ্নীশ্বর’-এর জন্য বি এফ জে এ ওকে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার অ্যাওয়ার্ড অফার করেছিল। কিন্তু ছবির পরিচালকের নাম পুরস্কারের তালিকায় নেই জেনে উত্তম সেই অ্যাওয়ার্ড প্রত্যাখ্যান করেছিল। এই ভালোবাসা আজকের দিনে ভাবা যায় না।’ এমনভাবেই, দু’জন সফল মানুষ, তাঁদের কেরিয়ারের উষালগ্নে যে বন্ধুত্বের সূচনা হয়েছিল, তাকে আমৃত্যু মর্যাদার সঙ্গে রক্ষা করেছেন।
ছবি: লেখক
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
শুধু উত্তমকুমারই নন, অন্যান্য নায়কদের কণ্ঠেও অবিস্মরণীয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়