“এই কয়েকদিন আগের ঘটনা। দিল্লিতে আমাদের সংস্থার বেশ কিছু সেফহাউস আছে; যেখানে ভিন্নধর্ম বা ভিন্নজাতে যারা বিয়ে করে, সেই দম্পতিরা থাকেন। নিজেদের জায়গায় সুরক্ষা, নিরাপত্তা না পেয়েই তাঁরা আমাদের কাছে আসেন। আমরাও তাঁদের সুরক্ষার ব্যবস্থা নিই। সেরকমই একটি বাড়ির যিনি মালিক, তিনি আমাদের কাছে আবেদন জানান যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে চলে যেতে। তাঁর বক্তব্য ছিল, এই কাজ তাঁর বাড়িতে অন্তত চলবে না; তাহলে তাঁর পরিবারের বাচ্চারা ‘সুশিক্ষা’ পাবে না। আমাদের লড়াইটা এই মানসিকতার বিরুদ্ধেও। আমরা যদি নিজেরা না বদলাই, শিক্ষিত না হই তাহলে ‘অনার কিলিং’-এর মতো ঘটনা ঘটবে না…”
প্রহরকে বলছিলেন আসিফ ইকবাল। তিনি এমন একটি কাজের সঙ্গে জড়িত, যা এই মুহূর্তে গোটা ভারতের পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আসিফ ইকবাল এবং তাঁর স্ত্রী রানু কুলশ্রেষ্ঠার হাত ধরেই গড়ে উঠেছে ‘ধানাক’। এই সংস্থা তো বটেই; আসিফ-রানু এবং তাঁদের মতো আরও দম্পতির প্রধান কাজ হল ভিন্নধর্ম, ভিন্নজাতের মানুষকে যারা সঙ্গী হিসেবে বেছে নেন, একসঙ্গে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেন, তাঁদের সেই স্বপ্নকে রক্ষা করা। তাঁদের সুরক্ষা দেওয়া, একটা সতেজ পরিবেশ দেওয়া…
হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন। এই মুহূর্তে ভারতের সামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতির অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হল ‘লাভ জিহাদ’। বিগত কয়েক বছর ধরে যেভাবে বেআব্রুভাবে এই মানুষদের ওপর আক্রমণ করা হচ্ছে তা নিন্দনীয়। “অবশ্য এসব কেবল বিগত কিছু বছরের ঘটনা নয়। ভারতের বুকে কৃমির মতো আটকে আছে অনার কিলিং। তুমি ভিন্নধর্মের কাউকে ভালোবাসতে পারবে না, ঘর বাঁধার স্বপ্ন তো অনেক দূরের কথা। এমনকি, আজও সমাজের বুকে জাতপাতের ঘটনা ঘটছে। কত দম্পতি, প্রেমিক-প্রেমিকা হুমকির মুখে পড়ছে, কতজনকে তো মেরেই ফেলা হচ্ছে। কিন্তু এঁরা তো কোনো ভুল কাজ করছে না! এঁদের সেই ছোট্ট কুঁড়িকে বাঁচানোর জন্যই আমাদের ‘ধানাক’-এর আগমন”, বলছিলেন আসিফ ইকবাল।
আরও পড়ুন
‘মারের মুখের উপর দিয়ে’ ফুল নয়, প্রতিবাদ আনলেন কৃষকরা
আসিফ আর রানু— দুজনের ধর্ম আলাদা। কিন্তু সেই বেড়াজাল দূরে সরিয়ে রেখে একে অপরকে ভালোবেসেছেন। একসঙ্গে ঘরও বেঁধেছেন। সমস্যা কি আসেনি? অনেক ঝড় পেরিয়েছেন দুজনে। পরিবার পাশে থাকলেও, সমাজ এবং প্রশাসনের তরফ থেকে বাধা এসেছে বিস্তর। তাহলে ভারতে কত মানুষ এরকম, বা এর থেকেও ভয়ংকর অবস্থার সম্মুখীন হয়? এই চিন্তা করতে করতেই তাঁদের সামনে এল গুজরাট দাঙ্গা। “তখন আমরা দেখছি, যে দম্পতিরা ভিন্নধর্মের, তাঁদেরকে খুঁজে খুঁজে নৃশংসভাবে হত্যা করা হচ্ছে। কেউ রক্ষা করার নেই। তখনই আমরা একটি সংস্থা তৈরি করার কথা ভাবলাম। ঠিক করলাম, ওই মানুষগুলোর পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হবে।” আর এভাবেই তৈরি হল ‘ধানাক’…
আরও পড়ুন
ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের জন্য বিয়ের বিধান তৈরির নির্দেশ কেরালার গির্জায়
নামটিও কিন্তু ভারী চমৎকার। আর কে না জানে, নামের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে লক্ষ্যের প্রতিফলন। ‘ধানাক’ একটি উর্দু শব্দ, যার অর্থ রামধনু। সমস্ত রং ধারণ করার ক্ষমতা থাকে রামধনুর। একটা ছাতা তৈরি করে আমাদের মাথায়; আর সাত রঙের মিশ্রণে যে বিশুদ্ধ আলো বেরোয়, সেই আলোই আমাদের পথ দেখায়। সেখানে কোনো রংকেই আলাদাভাবে চেনা যায় না, সব মিলিয়ে একটি শুদ্ধতার হাওয়া। ‘ধানাক’-এরও মূল লক্ষ্য সেটা। যারা সাহায্য চান, তাঁদেরকে সবরকমভাবে রক্ষা করা, তাঁদের দিকে আইনের হাতটিও বাড়িয়ে দেওয়া— সব নিয়ে সংস্থাটি সেই রামধনুর ছাতাই। ২০০৪-০৫ সালে প্রথম শুরু হয় ধানাকের পথ চলা। “কিন্তু আমরা দেখলাম, শুধু রক্ষা করলেই হবে না। সমাজের ভেতরে যদি সঠিক শিক্ষা না পৌঁছয়, মুক্তচিন্তা না ছড়ায় তাহলে তো আখেরে কোনো লাভই নেই। তাই কেবল আইনি সাহায্য বা মাথা গোঁজার আশ্রয়ই নয়; বাড়িতে গিয়ে কথা বলা, পরিবারকে বোঝানো, প্রতিটা জায়গায় সচেতনতা বৃদ্ধি করা— এগুলোও ধানাকের কাজ”, বলছিলেন আসিফ।
খুব স্বাভাবিকভাবে, এই কাজ করতে গিয়ে নানা ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। সেখানে যেমন আছে আলো, তেমনই আছে অন্ধকার। অনার কিলিংয়ের মতো ঘটনা আজও আমাদের স্তম্ভিত করে দেয়। শুধু কি হিন্দু-মুসলিম, বা উঁচু জাত-নিচু জাতের বিয়ে? তা কিন্তু নয়। একটু দক্ষিণ ভারতের দিকে গেলে সেখানে উঠে আসবে অন্যান্য ধর্মের সঙ্গে খ্রিস্টানদের সম্পর্কও। সেখানেও ঘটে অনার কিলিং। পরিবারের অত্যাচারে অনেক তরুণ-তরুণী আত্মহত্যাও করেন। কাউকে গোপনে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় ‘সমগোত্রীয়’ পরিবারের সঙ্গে। আর সেইসঙ্গে আছে লাভ জিহাদ।
আরও পড়ুন
পিতৃতন্ত্রের গোড়ায় আঘাত পাঞ্জাবের ব্যবসায়ীর, জন্ম নিল 'গুপ্তা অ্যান্ড ডটার্স'
এই সবকিছুই কি শিক্ষার অভাব? আসিফ এখানে একদম অন্য একটি প্রেক্ষিত নিয়ে আসেন। “শিক্ষা বলতে ঠিক কী বুঝি আমরা? যদি প্রথাগত বিদ্যা বলেন, যেটা শুধুমাত্র চাকরি পেতে সাহায্য করে, সেটাকে আমরা শিক্ষা বলতে অপারগ। শিক্ষা হল সেটা, যা আমাদের ভেতরের সত্তাকে চিনতে সাহায্য করে। শুধু নিজেকে নয়; সমাজ, দেশ, পৃথিবী, পরিবেশ সমস্ত কিছুকে চিনতে শেখায়। আমাদের চারপাশে যে ঘটনাগুলো পীড়া দেয়, শিক্ষাই সেগুলোকে দূর করতে সাহায্য করে। সেই শিক্ষার অভাব নিশ্চয়ই আছে। আর তার কোনো আর্থসামাজিক বিভাজন নেই। উপরমহল, ধনী থেকে ঝুপড়িবাসী গরিব— সবার মধ্যেই সচেতনতা আসতে পারে, সবার মধ্যে এমন শিক্ষার অভাব দেখা যেতে পারে। আমাদের সেই ব্যাপারগুলোকেই আগে আনতে হবে। যদি কেউ কথা না শোনে, তাহলে বাকিদের আওয়াজ হয়ে উঠতে হবে।”
আজ ৫০০০-এরও বেশি দম্পতির পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন আসিফ ইকবাল-রানু কুলশ্রেষ্ঠার ‘ধানাক’। ‘স্পেশ্যাল ম্যারেজ অ্যাক্ট, ১৯৫৪’-এর মাধ্যমে ওই মানুষগুলো যাতে নিজেদের স্বপ্নের একটা ঘর তৈরি করতে পারে, তারই চেষ্টা করা। সেইসঙ্গে সমাজের সর্বত্র সচেতনতা বৃদ্ধি করা। “সাম্প্রতিক একটি ঘটনার কথা বলি আপনাদের। দিল্লির একটি জায়গায় দেওয়াল লিখন, ছবি আঁকছিলাম আমরা। ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’, ‘আমার জীবন আমার সিদ্ধান্ত’ ইত্যাদি বেশ কিছু কথাই ছবির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছিলাম। হঠাৎ করেই কয়েকজন এসে আপত্তি জানাতে শুরু করল। দেওয়ালে আঁকা নিয়ে নয়; বরং যে কথাগুলো লেখা হচ্ছে সেগুলো নিয়ে আপত্তি। এসবের মাধ্যমে আমরা নাকি ‘ভুল বার্তা’ দিচ্ছি। আসলে জানেন তো, আমরা নিজেরাই নিজেদের গর্ত থেকে বের করাতে পারি না”, বলছিলেন আসিফ।
কথায় কথায় উঠে এল উত্তরপ্রদেশের সাম্প্রতিক আইনটির কথা। যেখানে ভিন্নধর্মে বিয়ে করার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। প্রশাসন তো আরও ইন্ধন যোগাচ্ছে এসব ক্ষেত্রে। তার দায়িত্ব সুরক্ষা দেওয়া; উল্টে আরও অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। সত্যিই কি এটা আমাদের ‘সংস্কৃতি’? এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে কতটা কঠিন হয়ে গেল কাজ? অকপটে এসব মেনে নিলেন আসিফ ইকবাল। “অবশ্যই অনেক কঠিন হয়ে গেছে। দায়িত্বও বেড়ে গেছে। কিন্তু আমরা আমাদের মতো করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব। প্রত্যেক মানুষের ভালোবাসার অধিকার আছে। নিজের মতো করে জীবনসঙ্গী খুঁজে নেওয়ার অধিকার আছে। সর্বোপরি, নিজের মতো বাঁচার অধিকার আছে। ভালোবাসা, প্রেমের আগে কোনো ধর্ম-জাত-লিঙ্গ আসে না। কিন্তু আমরা সেসবের অছিলায় নিজের ক্ষমতা জাহির করি। আসলে তো ক্ষমতার খেলা, তাই না?”
এবং, এই আকালেও আশা রাখেন আসিফ ইকবালরা। আশা রাখেন ‘ধানাক’-এর ওপর। বিশ্বাস করেন, একদিন না একদিন ঝড় থেমে যাবে। যে ভালো-বাসার স্বপ্ন দেখি সবাই, সেখানেই হাত ধরাধরি করে হাজির হব আমরা। খেয়ে নেব রাতের খাবার। রামধনু উড়বেই; মুক্তির আকাশে আবারও উড়বে পাখি। ‘ধানাক’-এর নিচে থাকব আমরা। থাকবেন আসিফ-রানুরা
Powered by Froala Editor