দার্জিলিং আর টয়-ট্রেন প্রায় সমার্থক। দার্জিলিং-হিমালয়ান রেলওয়ের ন্যারোগেজ ট্রেনের জন্যই ইউনেস্কোর হেরিটেজ তকমা পেয়েছে দার্জিলিং। তবে দার্জিলিং ছাড়াও ভারতের বুকে রয়েছে এমন এক শৈলশহর, যেখানে ন্যারোগেজ টয়-ট্রেনই একমাত্র গণপরিবহনের মাধ্যম। হ্যাঁ, এই ছোট্ট পাহাড়ি শহরে চলে না কোনো মোটরগাড়িই।
শৈলশহর (Hill Station) বলতেই অনেকে মনে মনে ভেবে ফেলেছেন আসাম, উত্তরাখণ্ড, হিমাচল কিংবা অরুণাচল প্রদেশের কথা। তবে এই অবাক করা শহরে পৌঁছাতে গেলে যেতে হবে দক্ষিণ ভারতে। হ্যাঁ, হিমালয় নয়, পশ্চিমঘাট পর্বতমালার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে এই হিল স্টেশন, মাথেরান। ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাই (Mumbai) থেকে এই শহরের দূরত্ব মাত্র ৯০ কিলোমিটার।
আজ থেকে প্রায় ১৭০ বছর আগের কথা। মুম্বাই সংলগ্ন থানা (আজকের থানে)-র তৎকালীন কালেক্টর হিউ ম্যালট জেলার জরীপ করতেই গিয়েই আবিষ্কার করেন চিরসবুজ অরণ্যে মোড়া ছোট্ট এই হিলস্টেশনটিকে। অবশ্য তখনও পর্যন্ত সভ্যতার ছাপ পড়েনি সেখানে। শান্ত নিরিবিলি পরিবেশের সঙ্গে বাড়তি পাওনা ছিল অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ও নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া। ফলে, গ্রীষ্মের ছুটি কাটানোর জন্য আদর্শ জায়গা হয়ে ওঠে এই অঞ্চল। কিছুদিনের মধ্যেই অস্থায়ী শহর তৈরির কাজও শুরু করে দেন ম্যালট। আজ যা পরিচিত মাথেরান (Matheran) নামে।
১৮৮০-র দশক পর্যন্ত, এই শহর ছিল মূলত ইউরোপীয় অভিজাতদের আবাসস্থল। পরবর্তীতে পার্সি ব্যবসায়ীরাই হয়ে ওঠে এই শহরের চালিকাশক্তি। বিশ শতকের শুরুর দিকে মাথেরানে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য পার্সি বাংলো। যার অধিকাংশই ধ্বংস হয়ে গেছে কালের আবহে। কিছু অবশিষ্ট থাকলেও, শোচনীয় অবস্থা তাদের। আর কিছু বাংলোকে বদলে ফেলা হয়েছে রিসর্টে।
তবে বিগত একশো বছর ধরেই সময় থমকে আছে এই শহরে। ব্রিটিশরা একসময় ন্যারোগেজ ট্রেন লাইন পেতেছিল এই ছোট্ট হিলস্টেশনে। তবে অস্থায়ী শহর হওয়ার জন্য আলাদা করে রাস্তা তৈরি করেনি আর। আজও সেভাবেই রয়ে গেছে মাথেরান। কোনো পাকা রাস্তা নেই সেখানে। আজও ইট আর সুরকির পথেই মানুষ যাতায়াত করেন সেখানে। দূষণ নিয়ন্ত্রণে বহু যুগ আগে থেকেই মোটরগাড়ির ব্যবহারও নিষিদ্ধ সেখানে। তবে কীভাবে যাতায়াত করেন এই অঞ্চলের মানুষ? এই প্রশ্নটাই ঘুরে ফিরে আসা স্বাভাবিক। তবে এক্ষেত্রেও সেই মধ্যযুগীয় সময়েই আটকে মাথেরান। পণ্য পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হয় ঘোড়া এবং গাধা। আর সাধারণ মানুষের গণপরিবহনের একমাত্র মাধ্যম সাইকেলরিক্সা। তবে স্থানীয়রা প্রায় সকলেই সাইকেল ব্যবহার করে থাকেন যাতায়াতের জন্য। আর পর্যটকরা?
মূল শহর থেকে মাইল পাঁচেক দূরে একটি জায়গা। নাম ‘দাস্তুরি নাকা’। বাইক হোক কিংবা মোটরগাড়ি— সেখানেই পার্ক করতে হয় সমস্ত মোটরচালিত যান। বাকি পথ হেঁটে অথবা রিক্সায় চড়ে পৌঁছাতে হয় মাথেরানে। দাস্তুরি নাকার পর নিষিদ্ধ শিল্পস্থাপন, কলকারখানা এমনকি খননকার্যও। এহেন ব্যবস্থা নেই গোটা এশিয়ায় দ্বিতীয় কোনো পাহাড়ি জনপদে। তবে ওই যে কথায় আছে না, পিঠে খেলে পেটে সয়। একটু কষ্ট সহ্য করে মাথেরানে পৌঁছাতে পারলেই স্বাদ পাবেন নৈসর্গিক দৃশ্যের। চিরসবুজ, ঝর্ণা, প্রজাপতির ঝাঁক মুগ্ধ করতে যে কাউকেই। কী ভাবছেন? একবার ঘুরে আসবেন নাকি এই ‘অখ্যাত’ শৈলশহরে?
Powered by Froala Editor