সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে ‘দিন্দা অ্যাকাডেমি’-র ট্রোল, ক্রিকেট কি এই স্পোর্টিং স্পিরিটই শেখাচ্ছে আমাদের?

প্রথম আইপিএলের ম্যাচে ইকোনমি ছিল ১৬.৩৩ রান। উইকেট সংগ্রহের ভাঁড়ারও শূন্য। প্যাট কামিন্স। ৩ ওভারে ৪৯ রান দেওয়ায় সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ট্রোল। তবে সেই ট্রোলের মূল বিষয়বস্তু তিনি হলেও টেনে আনা হল অন্য আরেকজনকে। বক্তব্য অনেকটা এমন, “কামিন্সও কি নাম লিখিয়েছেন ‘দিন্দা অ্যাকাডেমি’-তে?” হ্যাঁ, বাংলার পেসার অশোক দিন্দার কথাই বলতে চাওয়া হয়েছে। তবে শুধু গত ম্যাচে নয়, শেষ কয়েক বছর ধরেই এভাবেই অবলীলায় চলছে তাঁকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা, ট্রোল। বোলিং ইকোনমির প্রসঙ্গ আসলেই নোংরা ব্যক্তিগত আক্রমণের রূপ নিচ্ছে তা।

টি-২০ ক্রিকেটের শেষ কথাই হল রান। ঝড়ো ইনিংস, বড়ো রানের পাহাড় তৈরি করাই টি-২০ ক্রিকেটের মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। টেস্ট বা ওয়ান ডে-র মতো ধৈর্য ধরে লম্বা ইনিংস খেলার মতো প্রসঙ্গই ওঠে না সেখানে। যার স্ট্রাইক রেট যত বেশি, সেই তত ভালো ক্রিকেটার। আদর্শ ক্রিকেটারের এমনই সংজ্ঞা সেট করে দিয়েছে টি-২০ ফর্ম্যাট। যেখানে বোলারদের কোনো ভূমিকাই নেই। 

না, ভূমিকা নেই বলা ভুলই হবে খানিকটা। বিপক্ষের দল বেশি রান করলে তখন সেই দায় অবশ্যই বোলারের। কিন্তু কোনো দল দ্রুত অল-আউট হয়ে গেলে বোলারের কৃতিত্বকে কখনও প্রাধান্য দেওয়া হয় না টি-২০ ক্রিকেটে। সংগ্রহে উইকেট আসার পরেও। ব্যাটসম্যানের খারাপ পারফরম্যান্সকেই তখন দাঁড় করানো হয় কাঠগড়ায়। 

আইপিএলে অশোক দিন্দা খেলেছেন মোট ৭৮টি ম্যাচে। গড় ইকোনমি ৮.২ রান প্রতি ওভার। আর সেই কারণেই বছরের পর বছর ধরেই চলছে তাঁকে নিয়ে ট্রোল। সহজেই উপেক্ষা করে যাওয়া হচ্ছে দিন্দার শিকার করা ৬৯টি উইকেটের কথা। আইপিএলকে তাঁর বিদায় জানানোর পরেও। সত্যিই কি শালীনতার জায়গা রাখে এই মানসিকতা? ইকোনমিই কি শেষ কথা একজন বোলারকে বিচারের? মহম্মদ শামি’র এখনও অবধি আইপিএলে ইকোনমি ৮.৮। জশপ্রীত বুমরার ৭.৯। সেই হিসাব মতো মহম্মদ শামি এবং জশপ্রীত বুমরার মতো বোলারও নিশ্চয়ই খুব খারাপ পেসার। 

তবে আইপিএলে অশোক দিন্দা খুব বাজে পারফর্ম করা একজন বোলার নয় ধরেই নেওয়া গেল। কিন্তু তাঁর বাকি ক্রিকেট কেরিয়ার? কখনোই আলোর সামনে আনা হচ্ছে না সেই দিকটাই। বাংলা দলে অন্যতম ভরসাযোগ্য পেসার দিন্দাই। বাংলার হয়ে রঞ্জিতে ৩৩৬টি উইকেটের সর্বোচ্চ রেকর্ডও তাঁর নামে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা রণদেব বসুর উইকেট ২১৮। প্রথম শ্রেণীর ঘরোয়া ক্রিকেটে সব মিলিয়ে ৪২০টি উইকেটের শিকারি দিন্দা। ভারতের হয় ১৩টি ওয়ানডে ম্যাচে ১২ উইকেট, ৯টি টি-২০তে ১৭টি উইকেট। এগুলো কি শুধুই স্ট্যাটিসটিক্স? জাতীয় দলে দীর্ঘদিন সুযোগ না পাওয়ায় কোনোই কি গুরুত্ব নেই এদের? ফ্র্যাঞ্চাইসি ক্রিকেটই কি তবে শেষ কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন? সেই প্রশ্নই থেকে যায়। 

দিন্দার বাড়ি মেদিনীপুরের তমলুকের এক প্রত্যন্ত গ্রাম নৈছনপুরে। কর্কেট বলে খেলা ক্রিকেটের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল নিতান্ত কলকাতায় ঘুরতে এসেই। তবে অদম্য জেদ নিয়েই শুরু করেছিলেন একটা লম্বা দৌড়। কখনো মেদিনীপুর থেকে ভোর বেলায় ৪ ঘণ্টার জার্নি করে এসে ঘাম ঝরিয়েছেন টালিগঞ্জের পিচে। কখনো বাড়ি না ফিরে, কিছু না খেয়েই ঘুমিয়েছেন মাঠে। দৌড়াতে দৌড়াতে ক্রিজের কাছে এসে একটা লাফ। হাত ঘুরিয়ে ব্যাটসম্যানের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া লাল রঙের একটা গ্রহকে। তাঁর উড়ানটা থেমেছিল বাংলার দল হয়ে, জাতীয় দলে গিয়ে।

আরও পড়ুন
ক্রিকেট বলকেও হতে হবে ‘নিরামিষ’! ভেগানদের দাবিতে হাসি-ঠাট্টা সোশ্যাল মিডিয়ায়

তর্কের খাতিরে ধরা যাক, ক্রিকেটে চূড়ান্ত অসফল একজন খেলোয়াড় দিন্দা। কিন্তু অশোক দিন্দার এই লড়াইটাই অনুপ্রেরণা হয়ে উঠতে পারে হাজার হাজার প্রান্তিক প্রতিভাদের। তরুণ প্রজন্মের কাছে। সেই চেষ্টাটুকুও কি করে দেখা হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়? নাকি নিছকই নিজেদের ‘স্মার্টনেস’ প্রমাণ করতে গিয়েই ছোটো করা হচ্ছে এমন একজন লড়াকু ব্যক্তির কৃতিত্বকে? এই মানসিকতা একদিক থেকে তো বিরূপ ছবিই ফুটিয়ে তুলছে হাজার হাজার দারিদ্রের অন্ধকারে থাকা তরুণ ক্রিকেটারের মধ্যে। ভেঙে দিচ্ছে তাঁদের যত্নে বোনা স্বপ্নকে।

সাধারণ ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত বিভিন্ন পেজের কথা নয় বাদই দেওয়া গেল। খোদ রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরই এই নীচ মানসিকতার পরিচয় দিয়েছিল গত মরসুমে। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট ক্লাবের ফেসবুক ওয়ালে ট্রোল হচ্ছেন একজন ক্রিকেটার। এমনটা ভাবতে পারাও যেন অবাস্তব। এই কাজ ক্রিকেটারকে সামনে রেখে আসলে ক্রিকেটকেই ‘দুয়ো’ দেওয়া নয় কি? দিন দিন কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে খেলার স্পোর্টিং স্পিরিটটাই।

এসবের মধ্যেই গতকাল প্রকাশ্যে এসেছে আরও একটি সংবাদ। শেষমেশ গোয়ার হয়েই রঞ্জি খেলতে চলেছেন বাংলার এই পেসার। গত বছরই বাংলা দলের কোচের সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। দলের স্ট্র্যাটেজি নির্ধারণের সময় বারবার উপেক্ষিত হওয়ায় উগড়ে দিয়েছিলেন রাগ। তারই পাল্টা কোপ পড়েছিল তাঁর ওপর। বাংলার হয়ে সর্বোচ্চ উইকেট নেওয়া বোলারকেও বাদ পড়তে হয়েছিল দল থেকে। খেলার মাঠই হোক, কিংবা প্যাভিলিয়নের দর্শক কেউই কি চিনতে পারল ক্রিকেটের প্রতি তাঁর একাগ্রতাকে? ভালো পারফর্মেন্সের লক্ষ্যে অবিরাম ছুটে চলা এই পেসারটিকে? গোয়ার হয়েও হয়তো আরও একবার সেই প্রমাণ দেবেন অশোক দিন্দা। বার বার পড়ে গিয়েই উঠে দাঁড়ানো যে তাঁর রক্তেই। কিন্তু কবে পরিবর্তন হবে এই অসভ্য মানসিকতার? উত্তর জানা নেই...

আরও পড়ুন
কমিক্সের বই থেকে সোশ্যাল মিডিয়া; নতুন প্রজন্মের হাত ধরে মিমের জগতেও উজ্জ্বল টিনটিন

Powered by Froala Editor

More From Author See More