নিজের কলম দিয়ে তিনি দেখিয়েছিলেন বিংশ শতকের বাংলায় মেয়েদের অবস্থা। নিজেও যে লড়াই করেননি এমন নয়, সেখান থেকেই পেয়েছিলেন সৃষ্টির বীজ। পেয়েছিলেন প্রতিবাদের মন্ত্র। তাই তো শত শত মেয়ের ‘আশাপূর্ণা’ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তাই আজও, বাংলা সাহিত্যে নারীদের কথার অন্যতম মাধ্যম আশাপূর্ণা দেবী।
আশাপূর্ণা— নামটির পেছনেও রয়েছে সেই সমাজের গল্প। বাবা, হরেন্দ্রনাথ গুপ্ত এবং মা সরলাসুন্দরীর সংসারে তার আগে জন্ম নিয়েছিল আরও একটি কন্যাসন্তান। আর যাতে মেয়ে না হয়, সেজন্য আশা করে ছিলেন ঠাকুমা। পরবর্তীকালে পঞ্চম সন্তানটিও মেয়ে হলে ঠাকুমার বক্তব্য, অনেক হয়েছে মেয়ে। আর নয়। মেয়ের আশা পূর্ণ হয়েছে। সেখান থেকেই সদ্যোজাতের নাম ‘আশাপূর্ণা’।
সারাজীবনে অজস্র লিখে গেছেন তিনি। ছোটগল্প, উপন্যাস, ছোটদের গল্প, প্রবন্ধ— আরও কত কি! শুরুটা হয়েছিল অবশ্য কবিতা দিয়ে, মাত্র ১৩ বছর বয়সে ‘শিশুসাথী’ পত্রিকায় প্রকাশ পেল প্রথম কবিতা ‘বাইরের ডাক’। প্রথম লেখাতেই নজর টানলেন সম্পাদকের। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কিংবদন্তি সাহিত্যিক যিনি, তাঁর কোনোদিন প্রথাগত স্কুলশিক্ষাই হয়নি। এবারেও বাধা সেই ঠাকুমা। মেয়েরা আবার পড়াশোনা করে নাকি!
বাবা ছবি আঁকতেন, মা ছিলেন আদ্যোপান্ত বইপোকা। শাশুড়ির হুংকার সামলেও গোগ্রাসে গিলতেন বই। আর মায়ের দেখাদেখি, আশাপূর্ণাও। এইভাবেই জীবন থেকে খুঁজে পেয়েছেন লেখার রসদ। তাঁর নিজের কথাতেই, ‘সব সময় চেষ্টা করেছি আমার এই শখটাকে বাঁচিয়ে রাখতে। এবং অবশ্য সফলও হয়েছি। অন্য কোনও কিছুর ওপর আর তেমন আকর্ষণ ছিল না।’
রবীন্দ্রনাথও জীবনে এসেছেন বড় অদ্ভুতভাবে। একবার আশাপূর্ণা এবং সম্পূর্ণা— দুই বোন মিলে ঠিক করলেন রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখবেন। সেখানেই আবদার ‘নিজের হাতে আমাদের নাম লিখে উত্তর দিতে হবে।’ দুই কিশোরীর এমন অনুরোধ দেখে কী ভেবেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সেটা জানা যায় না। তবে উত্তর দিয়েছিলেন ঠিকই। ‘আশাপূর্ণা-সম্পূর্ণা’। ভবিষ্যতে সবদিক থেকেই প্রকৃত অর্থে সম্পূর্ণা হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
আশাপূর্ণা দেবীর কথা আসলে অবশ্যই সামনে আসে তাঁর ট্রিলজি’র কথা। ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’, ‘সুবর্ণলতা’, ‘বকুলকথা’। এই তিনটে উপন্যাসে কি নিজেই নিজেকে, নিজের পরিবারকে লিখেছেন আশাপূর্ণা? ‘বকুলকথা’-এর একটি জায়গায় তিনি লিখছেন—
“মা, মা গো! তোমার পুড়ে যাওয়া হারিয়ে যাওয়া লেখা, না-লেখা সব কথা আমি খুঁজে বার করবো। সব কথা আমি নতুন করে লিখবো। দিনের আলোর পৃথিবীকে জানিয়ে যাবো অন্ধকারের বোবা যন্ত্রণার ইতিহাস…’’
এই কথা কি আশাপূর্ণা দেবীর নিজেরও কথা নয়? ছোট থেকেই দেখেছেন অনুশাসন। মেয়েদের শিক্ষার অধিকার দেওয়া হত না, নিজেও পাননি। বইয়ের নেশা থাকলেও মা সরলাসুন্দরীকে লুকিয়ে সেই শখ মেটাতে হয়েছে। সেই কাহিনিই কি লিখে গেছেন এই তিনটি কালজয়ী উপন্যাসে? বারবার জীবনের ছবিই তুলে ধরেছেন তিনি। যা দেখেছেন সেটাই বলেছেন। নিজেই বলেছেন, ‘উচিত বলার আমি কে?’
তবে সবসময় মেয়েদের সপক্ষেও বলেননি তিনি। সোহাগের পাশাপাশি শাসনও করেছেন। মেয়েদের ‘আসক্তি’-কে তিরস্কার করেছেন তিনি। ব্যক্তিগত জীবনেও একইরকম ব্যক্তিত্বময়ী ছিলেন আশাপূর্ণা। ঠিক যেমন পাঠকরা দেখতে পেয়েছিলেন ‘সুবর্ণলতা’র মধ্যে, ঠিক তেমনটিই।
ঋণস্বীকার—
১) আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০১৫, ‘অর্ধেক আকাশ’
২) ইন্ডিক হাউজ, ২০১৮, ‘আশাপূর্ণা দেবী: যে পারে সে আপনিই পারে’
Powered by Froala Editor