মাস কয়েক আগের কথা। তালিবানের সঙ্গে দোহায় বিশেষ বৈঠক আয়োজন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র, আফগান সরকার এবং ন্যাটো। সেই বৈঠকেই স্বাক্ষরিত হয়েছিল শান্তিচুক্তি। আফগান ইতিহাস এবং প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সংরক্ষণের কথাও বলতে শোনা গিয়েছিল তালিবানদের। তবে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের পরেই বদলে গেল গোটা পরিস্থিতিটা। গনি সরকারের পতন ঘটিয়ে দু’দশক পর ফের আফগানিস্তানে স্থাপিত হল তালিবান রাজ। আর তালিবানদের এই আকস্মিক বিজয়ে যেন ধ্বংসলীলার একেবারে প্রান্তে দাঁড়িয়ে আফগান ইতিহাস, ঐতিহ্য।
ইতিপূর্বে তালিবান রাজত্বে গুঁড়িয়ে গিয়েছিল ঐতিহাসিক বামিয়ান বুদ্ধমূর্তি। শুধু এই বুদ্ধমূর্তিই নয় গোটা আফগানিস্তানই পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তূপে। পরবর্তীতে ন্যাটো ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যে ২০০১ সালে আফগান সরকার প্রতিষ্ঠার পর থেকে, আফগানিস্তানের ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চলগুলির সংরক্ষণের কাজ শুরু করেছিল একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা। কিন্তু সেসব স্থাপত্য, ভাস্কর্যের অস্তিত্ব টিকে থাকবে ক’দিন— তাই এখন প্রশ্নের মুখে।
গতকাল কাবুল দখল করে তালিবান গোষ্ঠী। তবে তার আগে থেকেই ক্রমাগত ফোন এবং এসএমএসে তালিবান সংগঠনের থেকে হুমকি উড়ে আসছিল আফগানিস্তানের সংরক্ষণকর্মী এবং অধ্যাপকদের কাছে। তালিবানের কান্দাহার এবং হেরাট দখলের পর থেকেই তাই দ্রুত প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রীর সুরক্ষা নিশ্চিত করার কাজ শুরু করেছিলেন কাবুল মিউজিয়ামের কর্মীরা। সংরক্ষিত নিদর্শন দেশের বাইরে পাঠানোর বন্দোবস্ত করেছিলেন ডিরেক্টর মহম্মদ ফাহিম রহিমি। কিন্তু সেই কাজও থেকে গেল অসম্পূর্ণ। গত তিন দিন আগে দেওয়ার তাঁর শেষ সাক্ষাৎকার অনুযায়ী তখনও পর্যন্ত কাবুল জাদুঘরে সংরক্ষিত ছিল প্রায় ৮ লক্ষ নিদর্শন।
গতকাল তালিবানদের কাবুল দখলের পর, প্রাণভয়েই আফগানিস্তান ছাড়ার হিড়িক পড়ে যায় সাধারণের মধ্যে। যাত্রীর আসনে জায়গা না পাওয়ায় বিমানের চাকায় উঠে অন্যত্র পাড়ি দেওয়ার ঘটনাও নজরে এসেছে কাবুল বিমানবন্দরে। এমন এক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে শেষ কয়েকদিনে প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রীর দেশান্তর প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল ঐতিহাসিকদের কাছে।
আরও পড়ুন
প্রাণহানি, অসম্পূর্ণ পড়াশোনা, বন্দিত্ব— তালিবান-জমানায় মহিলাদের ভবিতব্য?
তবে শুধু মিউজিয়াম নয়, গোটা আফগানিস্তান জুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অজস্র ইতিহাস। সিল্ক রুটের মধ্যবিন্দুতে অবস্থিত হওয়ায় আফগানিস্তানের সংস্কৃতিতে যেমন মিশেছিল চিন, ভারতের ঐতিহ্য; তেমনই স্পষ্ট ছাপ ছিল ইউরোপেরও। ফলত, বুদ্ধ, হিন্দু, খ্রিস্টান, জোরাস্ট্রিয়ান-সহ একাধিক ধর্মের সংমিশ্রণ ঘটেছিল আফগানিস্তানে। তারও বহু পরে সতেরো শতকে ইসলাম ধর্মের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে আফগানিস্তানে। তবে মৌলবাদী তালিবান রাজ কায়েম হওয়ার পরই বদলে যায় পরিস্থিতি। আফগানিস্তানকে সম্পূর্ণভাবে ইসলামিক রূপ দেওয়াই ছিল তালিবানের একমাত্র লক্ষ্য। আর সেই কারণেই প্রাচীন মঠ, বৌদ্ধ স্তূপ, কাফেলা, কুবলা খানের দরবার— সর্বত্রই ধ্বংসযজ্ঞ চালায় তালিবানরা।
আরও পড়ুন
তালিবানি আগ্রাসনের মধ্যেই শান্তির স্বপ্নে বুঁদ আফগানিস্তানের মহিলা সাংবাদিক
দু’দশক পেরিয়ে এসে আফগান ঐতিহ্যের অবশিষ্ঠাংশই পুনরায় প্রমাদ গুনছে ধ্বংসের। স্থানীয় কর্মীরা ছাড়া আফগান মিউজিয়াম এবং প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলির বৈদেশিক আধকারিকরা সকলেই ইতিমধ্যে পাড়ি দিয়েছেন অন্য দেশে। কাবুল দখলে প্রাক্কালে তালিবান হানার প্রতিরোধ জোরদার করতে এই অংশগুলি থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল আফগান সেনাবাহিনীকেও। ফলত, তালিবানদের আফগান ইতিহাস মুছে ফেলা এখন কেবলমাত্র সময়ের অপেক্ষা। তবে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলির দ্রুত পদক্ষেপে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি আটকানো যেতে পারে বলেই আশাবাদী ঐতিহাসিকদের একাংশ। কিন্তু স্বার্থ ছাড়া আদৌ কি এগিয়ে আসবে প্রথম বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলি? সেখানেই ঝুলে রয়েছে প্রশ্নচিহ্ন…
আরও পড়ুন
বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস— যে তালিবানি কীর্তির নিন্দায় আজও সরব বিশ্ব
Powered by Froala Editor