ধর্ম আলাদা, ‘হ্যালো’ এক – বিশ্বজুড়ে দেব-দেবীদের বিচিত্র যোগাযোগ

খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, হিন্দু কিংবা জুরোস্ট্রিয়ানিজম— প্রতিটি ধর্মেরই রয়েছে এক স্বতন্ত্র পৃথক ইতিহাস। প্রতিটি ধর্মের সঙ্গেই জুড়ে রয়েছে আলাদা আলাদা পৌরাণিক কাহিনি। তবে পুরোই কি ভিন্ন? না, বরং শিল্প এবং সংস্কৃতির প্রেক্ষিতে যেন একই সুতোয় বাঁধা পড়েছে প্রতিটি ধর্মকেই। প্রতিটি ধর্মের দেব-দেবীদের ক্ষেত্রেই রয়েছে একটি সাধারণ সাদৃশ্য। ঠিক কেমন?

ভারতের যে কোনো পৌরাণিক দেবতার ছবির দিকে তাকালেই বোঝা যাবে বিষয়টি। তা হল, যে-কোনো দেব-দেবীরই ঐশ্বরিক ক্ষমতার প্রতীক হিসাবে ছবিতে তাঁদের মাথার পিছনে ব্যবহৃত হয় উজ্জ্বল বৃত্তাকার আলোকজ্যোতি। ঐতিহাসিকদের কাছে এই আলোকজ্যোতি পরিচিত ‘হ্যালো’ হিসাবে। এবার হিন্দু ধর্ম থেকে খানিকটা সরে এসে যদি খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, পারসি কিংবা জুরোস্ট্রিয়ানিজমের দিকে যাওয়া যায়, সেখানেও দেখা যাবে এই একই ধরনের শিল্পকলার ব্যবহার। 

কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে জন্ম নেওয়া ধর্মগুলির মধ্যে এহেন সাদৃশ্যের কারণ কী? কীভাবেই বা প্রতিটি ধর্মের ক্ষেত্রে আধ্যাত্মিকতার প্রতীক হয়ে উঠল হ্যালো? এই উত্তর খোঁজার আগে, ফিরে দেখতে হবে ‘দেবতার জন্ম’-এর গল্পকে। ফিরে যেতে হবে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায়। যেখানে উপাস্য দেবতা হয়ে উঠেছিল প্রকৃতিই। হ্যালোর প্রাচীনতম নিদর্শন বা উদাহরণ পাওয়া যায় মিশরেই। খ্রিস্টপূর্ব আড়াই-তিন হাজার বছর আগে থেকেই সেখানে পূজিত হয়ে আসছেন সূর্যের দেবতা ‘রা’। আর পৃথিবীর আলোকশক্তির মূল উৎস সূর্যের প্রতীক হিসাবেই হ্যালোর ব্যবহার শুরু করেছেন মিশরীয়রা। তবে আজকের প্রচলিত হ্যালোর থেকে খানিকটা আলাদা ছিল সেই সৃষ্টি। ‘রা’-এর মাথার পিছনে নয়, বরং মাথার খানিকটা ওপরে সূর্যের প্রতীক হিসাবে বলয় অঙ্কন করেছিলেন মিশরীয়রা। 

অন্যদিকে এর প্রায় হাজার বছর পর ভারতের হরোপ্পা-মহেঞ্জোদারো সভ্যতাতে দেখা যায় হ্যালোর ব্যবহার। সেখানেও হ্যালো ব্যবহৃত হত খানিকটা অন্যভাবেই। আত্মার আধ্যাত্মিক শক্তির প্রকাশে পৌরাণিক ব্যক্তিত্বদের সারা শরীর থেকেই আলোকরশ্মি নির্গমনের ছবি অঙ্কন করেছিলেন তাঁরা। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদল হয় এই মানুষের কল্পনাশক্তিরও।

আরও পড়ুন
ধর্মান্তকরণে ব্যর্থ হয়ে হত্যা? পরিত্যক্ত স্কুলে ২১৫টি শিশুকঙ্কাল, বাড়ছে রহস্য

মাথার ঠিক পিছনে আলোকবৃত্তের ব্যবহার প্রথম লক্ষ করা যায় ইরানে। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ শতাব্দীতে জুরোস্ট্রিয়ান ধর্মে। আলোর দেবতা মিত্রার মাথার ঠিক পিছনে হ্যালোর ব্যবহার সেখানে সূর্যকেই উপস্থাপন করত। পরবর্তী কয়েকশো বছরের মধ্যেই এই শিল্পকলা ছড়িয়ে পড়ে টিউনিশিয়া, তুর্কি, রোম, চিন এবং বর্তমান পাকিস্তানে। সেসময় কম্বোডিয়ান বিভিন্ন মন্দিরের ফ্রেস্কোতে বুদ্ধের মাথাতেও দেখা যেত আলোর চাকতি। তিনশো শতাব্দীর কাছাকাছি খ্রিস্টধর্মের প্রভাব বিস্তারের পরে যিশুর ক্ষেত্রেও দেখা যায় একই ঘটনা। 

আরও পড়ুন
অস্ট্রেলিয়ার পরিবেশ বাঁচাতে স্কুল ধর্মঘটের ডাক ৫০ হাজার পড়ুয়ার

অর্থাৎ, এই সাংস্কৃতিক মোটিফ যে এক ধর্ম থেকে ভিন্ন ধর্মে স্থানান্তরিত ও বিবর্তিত তা স্পষ্ট। এবার প্রাচীন কালে এশিয়া এবং ইউরোপের সংযোগপথের মানচিত্রের দিকে তাকালেই পাওয়া যাবে ‘কীভাবে’র উত্তর। সিল্করুট। এই গিরিপথই ভারত, চিনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করত আফগানিস্তান, ইরান থেকে শুরু করে ইউরোপের দেশগুলিতেও। ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী দেশগুলিতেও মানুষ যাতায়াত করতেন এই পথেই। চলত বাণিজ্য। আর বাণিজ্যিকদের মধ্যে দিয়েই ছড়িয়ে পড়ত তাঁদের উপাস্য দেবদেবীদের মূর্তি এবং ছবি। আদান-প্রদান হত আধ্যাত্মিক চিন্তা-ভাবনার। 

আরও পড়ুন
ধর্মশালা, ধরমশালা, কিছু কথা

সেইসঙ্গে রোমান সাম্রাজ্যের পরিধিবিস্তারও হ্যালো-কালচার ছড়িয়ে পড়ার আরও একটি কারণ। প্রাচ্যের দেশগুলির ওপর রোমান সম্রাটদের ক্ষমতা বিস্তারের পর, ব্যাপক আকার নিয়েছিলেন এহেন শক্তিবলয়ের ব্যবহার। শুধু দেবতাদের ক্ষেত্রেই নয়, বরং সর্বশক্তিমানের প্রতীক হিসাবে সম্রাটদের বিভিন্ন ছবির ক্ষেত্রেও আঁকা হত হ্যালো। কনস্ট্যানটাইনের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল সেই চল। যা তৎকালীন শিল্পীদের কাছে হ্যালোর জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে তোলার অন্যতম কারণ। দেবতাদের ক্ষেত্রে হ্যালোর গণ-ব্যবহার শুরু হয় তারপর থেকেই। 

আজও অব্যাহত রয়েছে সেই ধারা। বিশ্বের প্রায় সমস্ত ধর্মের মধ্যেই সাধারণ বৈশিষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে হ্যালো। শুধু হারিয়ে গেছে ধর্মের মূলমন্ত্রই। সম্প্রীতির বার্তা কখন যে বদলে গেছে সংঘাতে— জানা নেই সেই উত্তর…

তথ্যসূত্রঃ
১. The halo: A symbol that spread around the world, Matthew Wilson, BBC
২. The Halo - religious iconography), buddha-heads.com

Powered by Froala Editor

More From Author See More