মার্সিন ওলেক্সি (Marcin Oleksy)। সাধারণ মানুষ তো বটেই, নিত্যদিন যাঁরা ফুটবল দেখতে অভ্যস্ত তাঁদের মধ্যে অনেকেই পরিচিত নন এই নামটির সঙ্গে। অথচ, রিচার্লিসন, দিমিত্রি পায়েতকে হারিয়ে এবার পুসকাস পুরস্কার ঝুলিতে পুরলেন তিনি। তৈরি করলেন এক নতুন ইতিহাস।
সোমবার প্যারিসে আয়োজিত হয়েছিল ফিফার বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। আর প্রথমবার এই মঞ্চ সাক্ষী হল আশ্চর্য এক দৃশ্যের। ক্রাচে ভর দিয়েই মঞ্চে উঠলেন পুসকাস পুরস্কার বিজয়ী। হ্যাঁ, আমাদের পরিচিত ফুটবলারদের সঙ্গে এখানেই তাঁর পার্থক্য। যৌবনেই কোঠায় হাজির হওয়ার পরই বাদ গিয়েছিল তাঁর একটি পা। তবে ফুটবল ছাড়েননি তিনি। বরং, খেলাকে আঁকড়েই নতুন করে শুরু হয়েছিল তাঁর বেঁচে থাকার লড়াই। আর এবার তার প্রতিদান পেলেন ওলেক্সি। বিশ্বের প্রথম প্রতিবন্ধী তথা অ্যাম্পিউটি ফুটবলার হিসাবে জিতলেন পুসকাস পুরস্কার (Puskas Award)।
গত ২০২২ সালের ৬ নভেম্বর। পোল্যান্ডের অ্যাম্পিউটি ফুটবল লিগ এক্সট্রাক্লাসায় রেজেসজোর বিরুদ্ধে অনবদ্য একটি গোল করেছিলেন ওলেক্সি। শূন্যে দেহ ছুঁড়ে, ক্রস থেকে ভেসে আসা বলে পা ছুঁইয়েছিলেন তিনি। আর এই সবটাই ক্রাচের ওপর ভর দিয়ে। বিপক্ষের গোলকিপার তো বটেই, তাঁর সতীর্থরাও অনুমান করতে পারেননি এমন জাদুকরী এক মুহূর্তের সাক্ষী হবে অ্যাম্পিউটি ফুটবল জগৎ। সে-সময় নেট-দুনিয়ায় সাড়া ফেলে দিয়েছিল এই অবিশ্বাস্য সিসার-কিক। সে-ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। তারপর?
তারপর স্বাভাবিক নিয়মেই অধিকাংশ মানুষ ভুলে গেছেন এই গোলের কথা। তাঁর নামটিও বা মনে রেখেছেন কতজন? এমনকি পোল্যান্ডের অ্যাম্পিউটি ফুটবলের অন্যতম তারকা, পুসকাস-জয়ী হওয়ার পরেও তাঁর নামে কোনো পেজই নেই উইকিপিডিয়ায়। সেখানে দাঁড়িয়ে ওলেক্সির এই পুসকাস-জয় ফুটবল-দুনিয়ার এক মাইলস্টোনই বটে।
অবশ্য এই লড়াই সহজ ছিল না খুব একটা। আজ থেকে ১২ বছর আগের কথা। তখন আর পাঁচজনের মতোই সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন তিনি। খেলতেন পোল্যান্ডের একটি দ্বিতীয় শ্রেণির ক্লাবে। ছিলেন গোলকিপার। তবে ঘরোয়া ফুটবল খেলে তো আর সংসার চলে না। তাই উপার্জনের বিকল্প পথ হিসাবে নির্মাণ প্রকল্পের শ্রমিক হিসাবে কাজ করতেন তিনি। আর তাতেই ঘটে যায় বিপত্তি। রাস্তা নির্মাণের কাজ করার সময়, গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হয় ওলেক্সি। পিষে গিয়েছিল একটি পা। সংক্রমণ রুখতে অস্ত্রোপচার করে বাদ দিতে হয় হাঁটুর নিচের অংশ।
স্বাভাবিক ফুটবলে সেই ইতি। এর বছর ছয়েক পর ফের ফুটবল জগতে ফেরা ওলেক্সির। অ্যাম্পিউটি ফুটবল সে-সময় মাথাচাড়া দিচ্ছে পোল্যান্ডে। শুরু হয়েছে নতুন লিগ। আর তাতেই নাম লেখালেন তিনি। তবে গোলকিপার নয়, অবস্থান পরিবর্তন করে খেলা শুরু করলেন স্ট্রাইকার হিসাবে। বলাই বাহুল্য, এই ছোট্ট সিদ্ধান্তই বদলে দিয়েছে তাঁর জীবন। বিগত কয়েক বছরে অ্যাম্পিউটি ফুটবলে পোল্যান্ডের অন্যতম ঘাতক স্ট্রাইকার হয়ে উঠেছেন তিনি। ঘরোয়া লিগ তো বটেই, ২০২২ অ্যাম্পিউটি ফুটবল বিশ্বকাপেও নিজের দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি। একক দক্ষতায় দলকে টেনে তুলেছিলেন শেষ ১৬-তে।
চলতি বছরে রিচার্লিসন, পায়েত, এম্বাপের মতো তারকাদের সঙ্গেই তাঁর নাম দেখা গিয়েছিল সেরা গোলস্কোরার মনোনয়ন তালিকায়। সমর্থন পেয়েছিলেন রবার্ট লিওনডস্কি-সহ অগণিত ফুটবলারের। তবে তখনও পর্যন্ত ওলেক্সি আশা করতে পারেননি, স্বাভাবিক ফুটবলারদের ভিড়ে দাঁড়াবার জায়গা পাবেন তিনি, পুসকাস নিতে মঞ্চে হাজির হতে হবে তাঁকে। অবশ্য শেষমেশ হল তেমনটাই। এ যেন এক রূপকথার জার্নি…
Powered by Froala Editor