দিল্লি এমন এক শহর, যার এককোণে মির্জা গালিবের ঠিকানা। আনুগত্য ও ভালোবাসার জন্য বিখ্যাত এই শহর। সেই দিল্লির দরিয়াগঞ্জের কাছে আসাফ আলি রোড। আসাফ আলি রোড থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরে বসন্ত বিহারের কাছে অরুণা আসাফ আলি মার্গ। দিল্লির এই দুটি রাস্তা একে অপরের সঙ্গে মেলে না। তবে এই দুই ব্যক্তি, যাঁদের নামে এই রাস্তাগুলি, তাঁরা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। ব্যক্তিগত সম্পর্কেও স্বামী-স্ত্রী ছিলেন তাঁরা। আসাফ আলি ছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের একজন সিনিয়র নেতা। যিনি ভগৎ সিংয়ের পক্ষে মামলাও লড়েছিলেন। অন্যদিকে, অরুণা আসাফ আলি (Aruna Asaf Ali) সেই মহিলা, যিনি ১৯৪২ সালের ৯ আগস্ট মুম্বাইয়ের (Mumbai) গোয়ালিয়া ট্যাঙ্ক (বর্তমানে আগস্ট ক্রান্তি ময়দান) ময়দানে তেরঙ্গা উত্তোলনের মাধ্যমে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন (Quit India Movement) শুরু করেছিলেন।
১৯৪২ সালের ৮ আগস্ট, কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি বম্বে অধিবেশনে ‘ব্রিটিশ ভারত ছাড়ো’ প্রস্তাবনা পাস করে। অরুণা ও আসাফ দুজনেই এই সম্মেলনে অংশ নেন। প্রস্তাবনা পাস হওয়ার পরের দিন অর্থাৎ ৯ আগস্ট সকালে ব্রিটিশরা কংগ্রেসের তাবড় নেতা মহাত্মা গান্ধি, বল্লভভাই প্যাটেল, নেহরু প্রমুখকে গ্রেফতার করে জেলে পোরে। এমন পরিস্থিতিতে অরুণা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে গোয়ালিয়া ট্যাঙ্ক ময়দানে তেরঙ্গা উত্তোলনের মাধ্যমে আন্দোলনের কেবল সভাপতিত্বই করেননি, ব্রিটিশ দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে ভারতীয়রা কী চান, স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন।
তেরঙ্গা উত্তোলনের পরে ব্রিটিশ পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে সেখানে জড়ো হওয়া লোকজনের উপর লাঠিচার্জ শুরু করে। অরুণা আসাফ আলি সেখান থেকেই সাধারণ জনগণের কাছে জাতীয়তাবাদের বার্তা দেন। যাতে খোদ ব্রিটিশ পুলিশ বুঝতে পারে তাদের দমন-পীড়নে আর চিঁড়ে ভিজবার নয়। পুলিশ ওইদিন অরুণাকে গ্রেফতার করতে পারেনি। কারণ তিনি চলে যান আন্ডারগ্রাউন্ডে। এমন সিদ্ধান্ত একজন বিচক্ষণ নেতাই নিতে পারেন। অরুণা মনে করতেন, তাঁকে বিপ্লবের জন্য তৈরি করা হয়েছিল, কারাবাসের জন্য নয়। যখন দেশ উত্তাল ছিল, গান্ধি-নেহরু জেলে, তখন আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে অন্যান্য বিপ্লবীর সঙ্গে সংযোগ রেখে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন অরুণা আসাফ আলি। ‘ডেইলি ট্রিবিউন’ অরুণা আসাফ আলিকে তাঁর সাহসিকতার জন্য ‘১৯৪২-এর ঝাঁসির রানি’ বলেও অভিহিত করে।
যদিও এর আগেও বহুবার গ্রেফতার হয়েছেন অরুণা। ১৯৩০ সালে ‘লবণ সত্যাগ্রহ’-এর সময় বন্দি হতে হয় তাঁকে। কারারুদ্ধ ছিলেন এক বছর। ১৯৩২ সালেও বছর খানেকের জন্য তাঁকে বন্দি থাকতে হয় তিহারে। এমনকী তাঁকে আম্বালা জেলে নির্জন কারাবাসও দেওয়া হয়েছিল। ব্রিটিশদের উদ্দেশ্য সাফ ছিল। তারা তাবড় সব নেতাকে কারারুদ্ধ করে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনকে দমন করতে চেয়েছিল। এখানেই ক্ষান্ত হয়নি ব্রিটিশরা। কংগ্রেসকে বেআইনি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণাও করে তারা। শহর ও গ্রামের স্থানীয় নেতাদের গ্রেফতার করা তো অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছিল ব্রিটিশরাজ। সে-সময় দেশে স্থিতিশীল নেতৃত্ব না থাকা সত্ত্বেও সারাদেশে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ সংঘটিত হয়েছিল। এটাই স্পষ্ট করে দিচ্ছিল যে, ভারতবাসীকে আর ব্রিটিশদের ‘দাস’ হিসেবে ভাবা যাবে না। অরুণা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাওয়ার পর ব্রিটিশরা তাঁকে গ্রেফতারের নির্দেশ জারি করে। ব্রিটিশ সরকারের সমস্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন। পুলিশ তার কাজ করতে থাকে, অরুণাও অরুণার কাজ করতে থাকেন। ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা যেন। কিন্তু যাঁর মোকাম দেশের স্বাধীনতা, তাঁকে কি আর সহজে পরাস্ত করা যায়? তিনি জিতেই ছাড়েন। পুলিশের খপ্পর থেকে পালিয়ে অরুণা প্রায় গোটা দেশে ঘুরে বেড়ান। স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত মানুষদের চেতনায় নতুন জাগরণ আনার কাজে যুক্ত হন। ব্রিটিশ সরকার কিন্তু সহজে ছাড়েনি। অরুণার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তা নিলামেও পর্যন্ত তোলে তারা। এতেও দমানো যায়নি তাঁকে। রাম মনোহর লোহিয়ার সঙ্গে মাসিক পত্রিকা ‘ইনকিলাব’ সম্পাদনার জন্য কাজ করেছিলেন অরুণা। এর দু-সপ্তাহ আন্ডারগ্রাউন্ড থাকার পর তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী ঊষা মেহতার সঙ্গে গোপনে রেডিয়ো স্টেশন থেকে সম্প্রচার শুরু করেন। শুনলে হয়তো চমকে যাবেন, ব্রিটিশ সরকার অরুণা আসাফ আলি মাথার দাম পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার রাখে। কোনও লাভ হয়নি। এভাবে চলে প্রায় চার বছর।
১৯৪৬ সালে তাঁর গ্রেফতারি পরোয়ানা বাতিল করা হয়। তিনি আত্মসমর্পণ করেন। স্বাধীনতা বেশি দূরে ছিল না। এক বছর পরে যখন দেশ স্বাধীন হয়, অরুণা আসাফ আলি দিল্লি প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পান। ১৯৫৮ সালে তিনি দিল্লির প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন তিনি। দেশভাগের সময় দিল্লিতে উদ্বাস্তুদের সমস্যা সমাধানে অবদান রাখেন অরুণা। ভারত-রাশিয়া ইন্সটিটিউট অফ কালচারের সদস্য হিসেবে তিনি এই দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব অটুট রাখতে সহায়তাও করেছেন। ‘অল ইন্ডিয়া পিস কাউন্সিল’ এবং ‘ন্যাশনাল ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান উইমেন’ এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলিতে সক্রিয় ছিলেন অরুণা। তিনি দিল্লিতে অবস্থিত লেডি আরউইন কলেজ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। দিল্লি থেকে প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিক ‘প্যাট্রিয়ট’-এর সঙ্গে আজীবন যুক্ত ছিলেন।
১৯৭৫ সালে লেনিন শান্তি পুরস্কার, ১৯৯২ সালে পদ্মবিভূষণে ভূষিত হন অরুণা। ১৯৯৬ সালের ২৯ জুলাই প্রয়াত হন তিনি। মরণোত্তর, ১৯৯৭ সালে ভারত সরকার তাঁকে ‘ভারতরত্ন’ দিয়ে সম্মানিত করে। স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী এই নারী বিভিন্ন সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। স্বামীর সঙ্গে এক কামরার ফ্ল্যাটে থাকতেন। সাধারণ যানবাহনে যাতায়াত করতেন। কিন্তু এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, কারণ অরুণা আসাফ আলি সেই মহিলা যাঁর সম্পত্তি নিলাম করেও ব্রিটিশরা তাঁর দেশের প্রতি নিবেদিত ‘আত্মা’কে ভাঙতে পারেনি। পরে অরুণা আসাফ আলি তাঁর বই ‘রেসুরজেন্স অফ ইন্ডিয়ান উইমেন’-এ লিখেছেন, ‘‘আগস্ট ৯, ১৯৪২, আমরা যে ফ্ল্যাটে থাকতাম তার দরজায় পুলিশ ধাক্কা দেয়। আসাফ সাহেবকে গ্রেফতার করলে আমি তাঁদের জিজ্ঞেস করলাম আমার জন্য কী খবর? তাঁরা বললেন, ‘তোমার জন্য কোনও পরোয়ানা নেই’।’’
তাঁর লেখা পড়লে জানা যায়, ‘ধীরুভাই দেশাইও ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস স্টেশনে উপস্থিত ছিলেন। তিনি আমাকে তাঁর গাড়িতে বসিয়ে গোয়ালিয়া ট্যাঙ্ক গ্রাউন্ডে নিয়ে যান। সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করে অনুষ্ঠিতব্য জনসভাকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়। একজন সাদা সার্জেন্ট ভিড়কে ছত্রভঙ্গ করার আগে মাত্র দুই মিনিট সময় দেন। আমি দ্রুত মঞ্চে উঠি এবং কংগ্রেসের পতাকা উত্তোলনের জন্য স্ট্রিং টেনে নিয়েছিলাম। আমি এমনটা করার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ জনতার দিকে টিয়ার গ্যাসের শেল ছুড়তে শুরু করে।’ এখানেই ভারত ছাড়ো আন্দোলনের আসল সূচনা হয়েছিল। অন্যদিকে, তাঁর আন্ডারগ্রাউন্ড থাকা প্রসঙ্গে পরবর্তীতে কংগ্রেস নেতা ও লেখক সত্যবতী মালিকের কন্যা কপিলা বাৎস্যায়ন তাঁর একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘অরুণা আসাফ আলির রাতে বাড়ি আসা এবং কেউ খেয়াল করার আগেই খুব ভোরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া আমাদের জন্য একটি অন্যরকম থ্রিলার ছিল। একটি গোয়েন্দা নাটকের চরিত্রের মতো উত্তেজনাপূর্ণ সেসব।’ যদিও আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে কাজ করা মহাত্মা গান্ধির নীতির বিরুদ্ধে ছিল। তা সত্ত্বেও অরুণা আসাফ আলির প্রতি গান্ধির স্নেহ কমেনি। ৯ জুন, ১৯৪৪-এ অরুণাকে একটি চিঠিতে গান্ধি লিখেছিলেন, ‘আমার হৃদয় তোমার সাহস এবং বীরত্বের প্রশংসায় পূর্ণ। কিন্তু আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে জীবন কাটিয়ে করা উচিত নয়। তুমি আত্মসমর্পণ করো এবং গ্রেফতারের জন্য ঘোষিত পুরস্কার গ্রহণ করো। সেই অর্থ হরিজন সভা সংঘের কাজের জন্যও দিতে পারো।’ আন্ডারগ্রাউন্ড জীবনে অরুণার সবচেয়ে হৃদয় বিদারক অভিজ্ঞতা হয়েছিল ১৯৪৩ সালে, কলকাতায়। গভীর অন্ধকার রাতে রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় হোঁচট খান তিনি। তাকিয়ে দেখেন, দুর্ভিক্ষের শিকার হওয়া এক দেহ। সে বলছে, ‘মা, আমাকে ভাত দাও...’ সেই করুণ ডাক অরুণা আসাফ আলি কখনও ভুলতে পারেননি। উত্তরপ্রদেশের পশ্চিম কিংবা হরিয়ানা, পঞ্জাব কিংবা পশ্চিমবাংলা, ফসল কাটার শ্রমিকের অভাব এখন। গম, রবিশস্য, ডাল, তৈলবীজ, ধান সব মাটিতে মিশে যাচ্ছে। ভাত-ডাল-রুটির জোগাড় করবে কে? গরমের সবজি ‘সোনার’ বাংলার মাটিতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। উৎপাদনেরও খরচ উঠছে না চাষির। তার ওপর বছরখানেক আগে বিতর্কিত কৃষি বিল নিয়ে দেশের উত্তাল হওয়ার কথা এখনও টাটকা। ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউট একটি সমীক্ষা করেছিল কিছুদিন আগে। সমীক্ষায় বলা হয়েছে, করোনাকালে তিন শতাংশেরও বেশি কমেছে মাথাপিছু ভোগব্যয়। সুতরাং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যও কেনার ক্ষমতা হারাতে বসেছি ‘বেশিরভাগ’ আমরা। আর বিগত ক-বছরে নোটবন্দি, জিএসটি; এসবের ফলে অর্থনৈতিক অবস্থাও যে খুব সুখের জায়গাতে, তা নয়। ফের আসবে না তো দুর্ভিক্ষ? স্বাধীনতার এই ৭৬ বছরে এই আশঙ্কার কথা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। যে আশঙ্কা ’৪৩-এ প্রত্যক্ষ করেছিলেন অরুণা আসাফ আলিও।
Powered by Froala Editor