দুর্গার মধ্যেই পরিযায়ী মা-কে দেখতে পেলেন শিল্পী পল্লব ভৌমিক

গত মার্চে লকডাউন ঘোষণার পরই প্রকট হয়েছিল পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা। একদিকে যেমন উপার্জনের পথ বন্ধ হয়েছিল। তেমনই অন্যদিকে বাড়ি ফেরার রাস্তাও কার্যত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তাঁদের। এবারের পুজোয় তাঁদের সেই যন্ত্রণা, অসহায়তার ছবিই ফুটে উঠল থিম হিসাবে। বেহালার বড়িশা ক্লাবে এবার দুর্গাকে দেখা যাবে পরিযায়ী শ্রমিকের রূপেই।

লকডাউনে পর্যাপ্ত ছিল না পরিবহন ব্যবস্থা। ছোট্ট শিশুকে নিয়েই মাইলের পর মাইল হেঁটে বাড়ি ফিরতে দেখা গিয়েছিল পরিযায়ী শ্রমিক মাকে। তাঁদের অনেকের ফেরাও হয়নি শেষ অবধি। রাস্তাতেই থেমে গিয়েছিল পরিযায়ন। দেবী-প্রতিমায় এবছর মূর্ত সেই পরিযায়ী মায়েরই প্রতিকৃতি। ক্লান্ত পায়ে হাঁটতে হাঁটতেই তিনি পিছন ঘুরে দেখার চেষ্টা করছেন আশার সামান্য আলো। তাঁর ফ্যাকাশে শাড়ির আঁচলের পিছনে দুই মেয়ে ও এক ছেলে। কোলে আরেক ছেলে। তাঁদের হাতে কুঁকড়ে গুটিয়ে থাকা হাঁস কিংবা পেঁচা। তারা যেন হয়ে উঠেছে দারিদ্র্যেরই ছাপ। অন্যদিকে পুরো মণ্ডপ জুড়ে ছড়িয়ে থাকবে ত্রাণের বস্তা। সেই সামান্য সাহায্যের দিকেই যেন হেঁটে যাওয়া দেবীর। যে দৃশ্যের সঙ্গে নাগরিকরা মেলাতে পারছেন শিল্পী বিকাশ ভট্টাচার্যের আঁকা একটি ছবিকেও। 

কৃষ্ণনগরের শিল্পী পল্লব ভৌমিক এই পরিযায়ী মায়ের রূপেই এবারে ফুটিয়ে তুলেছেন দেবী দুর্গাকে। কিন্তু কেন এই চিন্তাভাবনা? তিনি জানালেন, “লকডাউন ঘোষণার পর পরিযায়ী শ্রমিকদের দুরাবস্থার কথা সামনে এসেছিল সংবাদমাধ্যমেই। এই অসহায় প্রেক্ষাপটই প্রভাবিত করেছিল আমায়। এবং এই মূর্তির মাধ্যমে নারী রূপকেই দেখানো হয়েছে। মাতৃত্ববোধকে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও সন্তানদের রক্ষা করার যে অদম্য জেদ, সেই জেদই প্রতিফলিত হয়েছে প্রতিমায়।”

পল্লববাবু জানান, মহামারীর কারণে ঠিক ছিল না পুজোর। তাই শেষ লগ্নেই ক্লাবের আলোচনায় ডাক আসে তাঁর। গত কয়েক বছর ধরেই এই ক্লাবের থিমের বিভিন্ন কাজই করে আসছেন গভার্নমেন্ট আর্ট কলেজের এই শিল্পী। তবে বড়িশার হয়ে প্রতিমা তৈরির কাজ এই বছর তাঁর প্রথম। মাটির বদলে ফাইবার দিয়েই তৈরি হয়েছে মূর্তিটি। উচ্চতা ১১ ফুট।

লকডাউনের কারণে এবছর টান পড়েছে বাজেটেও। তবে সেই কারণে থেমে থাকেনি তাঁর কাজ। তাকে উপেক্ষা করেই পল্লব ভৌমিক ফুটিয়ে তুলেছেন দেবীর মৃন্ময়ী পরিযায়ী রূপ। সময়ও যে খুব বেশি পেয়েছেন এমনটা নয়। মাত্র ২ মাসের মধ্যেই শেষ করেছেন প্রতিমা নির্মাণের কাজ।

আরও পড়ুন
দর্শকহীন পুজোর সিদ্ধান্ত সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের, একই পথে হাঁটবে অন্যরাও?

প্রতিমা ছাড়াও পুরো মণ্ডপের থিমেও থাকছে অভিনবত্ব। লকডাউন চলাকালীন ক্লাব কর্তৃপক্ষের তরফেও দেওয়া হয়েছিল ত্রাণ। চাল, ডাল, আলুর সেইসব বস্তাই ব্যবহৃত হয়েছে মণ্ডপ সজ্জায়। প্রতিফলিত করেছে খাদ্যের হাহাকারকে, ক্ষুধাকে।

কিছুদিন আগেও কেন্দ্রীয় সরকারের বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যুর কোনো তথ্যই নেই তাঁদের কাছে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী সারা দেশে অন্তত ৯৫২ জন পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে লকডাউনে। কাজ হারিয়েছেন আরও লক্ষ লক্ষ মানুষ। আর্থিক সচ্ছলতার পথে এখনও ফিরতে পারেননি কেউ কেউ। লড়াই করে যাচ্ছেন এই নিম্নমুখী অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে। সেই করুণ অবস্থাকেই যেন প্রশ্নের কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন শিল্পী পল্লব ভৌমিক। চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছেন বাস্তব পরিস্থিতিকে...

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
ফিরছে ডবল ডেকার বাস, পুজোয় নস্টালজিয়ার ছোঁয়া কলকাতায়

More From Author See More