কথায় আছে ‘পেন ইজ মাইটার দ্যান দ্য সোর্ড’। তবে শুধু পেন বললে শিল্পের ক্ষমতা, তার পরিধিকে অনেকটাই সরলীকৃত করে বলা হয়। চিত্রশিল্পী হোক বা থিয়েটার, সাহিত্য হোক বা সঙ্গীত— প্রতিটি শিল্পের মধ্যেই রয়েছে এক সংবেদনশীল শক্তি। যা ছুঁয়ে যেতে পারে আবেগকে, ফিরে দিতে পারে না পাওয়া অনুভূতিদের। সম্প্রতি আরও একবার প্রমাণ মিলল তার। মৃত বাবার স্পর্শ ফিরিয়ে দিলেন শিল্পী। মিলিয়ে দিলেন বিবাহবেশের কন্যার সঙ্গে।
২০০৪ সাল। ষষ্ঠ শ্রেণির গণ্ডিও তখন পেরোননি চন্দননগরের বাসিন্দা বনিতা ঘোষ। বয়স আর কতই বা? বছর এগারো-বারো। অথচ সেই অল্প বয়সেই বাবাকে হারিয়েছিলেন বনিতা। তারপর বয়স বেড়েছে। হয়েছে বিবাহও। জীবন এগিয়েছে নিজের মতো। শুধু শূন্যতা থেকে গেছে পিতৃত্বের জায়গাটায়। আর পাঁচজনের মতো বনিতাও চেয়েছিলেন বিবাহের দিনে তাঁর পাশেই থাকুন তাঁর বাবা। তাঁর হাতের স্পর্শ যেন আশীর্বাদ এনে দিক পরবর্তী অধ্যায়ের জন্য।
সপ্তাহ খানেক আগে ফেসবুকেই তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল চিত্রশিল্পী সিম্পি চট্টোপাধ্যায়ের। তাঁর আঁকা বেশ কয়েকটি পোর্ট্রেট দেখেই বনিতা অনুরোধ করেছিলেন, বিবাহবেশী তাঁর সঙ্গে বাবার একটি ছবি এঁকে দিতে। আর তারপরই অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলেন শিল্পী। রঙ-তুলিতে মিলিয়ে দেন বাবার স্পর্শকে। তবে খুব সহজ ছিল না এই কাজ। কারণ সম্বল বলতে প্রায় দু’ দশক আগের তোলা একটি ছবিমাত্র। সেই নমুনার অবলম্বনেই সম্পূর্ণ ছবিটি নির্মাণ করেন চিত্রশিল্পী সিম্পি চট্টোপাধ্যায়। এ যেন এক অভিনব সৃষ্টি।
না পাওয়া অনুভূতি ফিরে পেয়ে বনিতা জানান, “ছোটবেলার স্মৃতি প্রায় মুছে গেছে বললেই চলে। বহুদিনের পুরনো একটা ছবি থেকে এইভাবে যে উনি ফিরিয়ে দেবেন তা ভাবতেও পারিনি। ছবিটা দেখে বোঝার উপায় নেই। আমার মা-ও দেখার পরে বললেন একদম একইরকম হয়েছে। ২৬ তারিখ বাবার মৃত্যুদিন ছিল। উনি ওইদিনই ছবিটা আমাকে এঁকে দেন।” জানা গেল, অনুরোধ করার মাত্র চারদিনের মধ্যেই এই অসাধ্যসাধন করেছেন চিত্রশিল্পী। আর তাঁর এই শিল্পকর্মে এককথায় বাকরুদ্ধ খোদ বনিতাও।
আরও পড়ুন
বৈপ্লবিক স্পাটসা গ্যালারির প্রতিষ্ঠাতা তিনি; প্রয়াত বিট যুগের শেষ চিত্রশিল্পী দিমিত্রি গ্রাচিস
অন্যদিকে, শিল্পী সিম্পি চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “এর আগেও আমি এমন একটি কাজ করেছিলাম এক বান্ধবীর জন্য। তারও বাবার সঙ্গে কোনো ছবি ছিল না। দুটো পুরনো ছবি থেকেই এঁকে দিয়েছিলাম। সেই ছবিটা দেখেই বনিতা যোগাযোগ করেন আমার সঙ্গে। অনুরোধ করেন, যদি বাবার সঙ্গে একটা ছবি এঁকে দিই তবে ওঁর বিয়ের অ্যালবামটা পরিপূর্ণ হয়ে যাবে। শারীরিকভাবে তো ফেরাতে পারব না কিন্তু ছবির মাধ্যমে যেটুকু করা যায়, সেই চেষ্টাই করেছি। ভীষণই ভালো একটা অনুভূতি, সেটা বলে বোঝানো যাবে না।”
সিম্পি চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি কলকাতার নিকটবর্তী সোনারপুর অঞ্চলে। কথায় কথায় জানা গেল, ছোট থেকেই ছবি আঁকতে ভালোবাসতেন তিনি। তবে পেশাদার চিত্রশিল্পী হয়ে ওঠা এই লকডাউনেই। আসলে পছন্দের জায়গা হলেও কোথাও যেন আঁকাটা প্রাধান্য হারিয়ে ফেলছিল তাঁর জীবনে। তবে পরিবার, স্বামী, শ্বশুর-শ্বাশুরির অনুরোধেই আবার নতুন করে হাত লাগিয়েছিলেন ফেলে আসা শখে। গত আগস্ট মাস থেকে ধীরে ধীরে শুরু করেন পেশাদার ছবি আঁকা। শুরুতে ন্যূনতম মূল্যের বিনিময়েই ছবি আঁকতেন তিনি। সামাজিক মাধ্যমে পরিচিতরাই এগিয়ে এসেছিলেন ক্লায়েন্ট হিসাবে।
আরও পড়ুন
একইসঙ্গে দশটি তুলি দিয়ে আঁকেন ছবি, বেলারুশের ‘অতিমানবিক’ চিত্রশিল্পীর গল্প
পেন্সিল স্কেচ হোক কিংবা রং-তুলি - সবকিছুতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন শিল্পী সিম্পি চট্টোপাধ্যায়। তবে পছন্দের জায়গা মূলত পোর্ট্রেট আঁকাই। তবে তাঁর সদ্য-অঙ্কিত এই পোর্ট্রেটটি শুধু আটকে নেই ছবির পর্যায়ে। বরং কোথাও গিয়ে স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার অঙ্গীকার হয়ে উঠেছে তা। সেখানেই বোধ হয় জিতে যাওয়া একজন শিল্পীর…
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
চিত্রশিল্পীদের ছবিতে বারবার হাজিরা দিয়েছে মাছি, কিন্তু কেন?