ইংল্যান্ডের শ্যাফর্ডশায়ার অঞ্চলের ছোট্ট গ্রাম গ্রেট অয়ারলে। নামে মহৎ হলেও নিছকই সাদামাটা গ্রাম। গোটা গ্রাম জুড়ে বসবাস কয়েক ঘর কৃষক আরর পশুপালকের। আজ থেকে ১১৮ বছর আগে সেখানেই ঘটতে শুরু করে এক অদ্ভুত ঘটনা। এক ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড। তবে মানুষ নয়, অজানা আততায়ীর হাতে খুন হচ্ছিল নিরীহ গবাদি পশু আর ঘোড়া। শেষ পর্যন্ত ঘটনার তদন্তে নামেন খোদ স্যার আর্থার কোনান ডয়েল। হ্যাঁ, নিজের সৃষ্ট চরিত্র শার্লক হোমসের হ্যাট মাথায় নিয়ে হাজির খোদ লেখক। আর সেই সূত্রেই এক ভারতীয়ের সঙ্গে গড়ে উঠেছিল নিবিড় বন্ধুত্ব। সেই বন্ধুত্ব বজায় ছিল ১৯৩০ সালে ডয়েলের মৃত্যুর সময় পর্যন্ত।
মূল ঘটনায় প্রবেশ করার আগে কিছুটা সময় আরও পিছিয়ে যাওয়া যাক। পরাধীন ভারতবর্ষ থেকে তখন ব্যবসার উদ্দেশ্যে বিলেতে পাড়ি দিচ্ছেন অনেকেই। তৎকালীন বোম্বাই থেকে এমনই এক পার্সি ভদ্রলোক পৌঁছে গেলেন গ্রেট অয়ারলে গ্রামে। তাঁর নাম শাপুরজি এদালজি। তবে ব্যবসায় উন্নতি আর হল না। বরং মেতে উঠলেন ধর্মকর্ম নিয়ে। স্থানীয় গির্জার রেভারেন্ড হিসাবে শপথ নিলেন কিছুদিনের মধ্যেই। আর ১৮৭৬ সালে শার্লট নামে স্থানীয় এক যুবতীকে বিয়ে করে স্থায়ী সংসার পাতলেন বিলেতে। তিন সন্তান নিয়ে সুখী পরিবার। কিন্তু সুখ বেশিদিন সহ্য হল না। কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হল এক উপদ্রব। সাদা চামড়ার মানুষদের মাঝে কেবল এক ঘর কালো চামড়ার নেটিভের উপস্থিতি কিছুতেই মেনে নিতে চাইছিলেন না স্থানীয়রা। তাও আবার তিনিই গির্জার রেভারেন্ড? ব্রিটিশদের জাত্যাভিমানে বড়ো আঘাত করেছিল এই পদমর্যাদা। শাপুরজি-শার্লটের প্রথম সন্তান জর্জের যখন ১০ বছর বয়স, তখন তাকে একটি ধর্ষণকাণ্ডে ফাঁসানোর চেষ্টাও হয়। তবে সেই মামলা মিথ্যা প্রমাণ হলেও বিদ্বেষাত্মক ব্যবহার চলতেই থাকে।
এরপর ১৯০৩ সালে ঘটে প্রথমে বলা ঘটনা। স্থানীয় মানুষ এবং পুলিশের কড়া প্রহরার মধ্যেও হত্যাকাণ্ড চলতেই থাকে। শুধুই তো পশুহত্যা নয়, এর সঙ্গে যে গ্রামের মানুষদের রুটিরুজিও জড়িয়ে। শ্যাফর্ডশায়ারের ঘটনার কথা ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত ইংল্যান্ডে। তবে কিছুদিনের মধ্যেই পুলিশ গ্রেপ্তার করে জর্জ এদালজিকে। অর্থাৎ শাপুরজি এদালজির প্রথম সন্তান জর্জ। সে ততদিনে শ্যাফর্ডশায়ারের একজন তরুণ উকিল। পুলিশ হঠাৎ জর্জের ঘর তল্লাসি করে। সেখান থেকে পাওয়া যায় একটি জ্যাকেট, যাতে ঘোড়ার লেজের চুল লেগে ছিল। আর পাওয়া গেল একটি ক্ষুর। জর্জের মতে সেটা তার দাড়ি কামানোর ক্ষুর। কিন্তু পুলিশ সে-কথা শুনতে নারাজ। তাঁরা দুইয়ে দুইয়ে চার, অথবা পাঁচ করে ফেলেছেন।
বিচারে জর্জ দোষী সাব্যস্ত হলেন। এমনটা তো ইউরোপের ইতিহাসে বহুবার ঘটেছে। যে-কোনো অপরাধের দায় নিতে হয়েছে প্রবাসী নেটিভদের। আর বিচারকের যুক্তি ছিল, জর্জ ধর্মান্তরিত হলেও আসলে তো পার্সি। পার্সিরা তো বলিদান প্রথায় বিশ্বাসী। অতএব এই কাজ যদি কেউ করে থাকে, সেটা অবশ্যই জর্জ। উল্টোদিকে অবশ্য জলজ্যান্ত প্রমাণ ছিল, জর্জ কারাগারে থাকা সত্ত্বেও গ্রেট অয়ারলেতে পশুহত্যা চলতেই থাকে। কিন্তু সেটা বড়ো কথা নয়। যাই হোক, জর্জ কারাবাস থেকে মুক্তি পেলেও তিনি আর কোনোদিন আদালতে প্র্যাকটিস করতে পারবেন না বলে ঠিক হয়।
আরও পড়ুন
প্যারাস্যুটে গোপন বার্তা, ‘পার্সিভারেন্স’ রোভারের সঙ্গে জড়িয়ে শার্লক হোমসও!
কারাগারে থাকার সময় জর্জ শার্লক হোমসের কাহিনি পড়েছিলেন। তখনই মনে হয়েছিল, এমন একজন গোয়েন্দা থাকলে তাঁকে নিশ্চই বাঁচাতে পারতেন। বাড়ি ফিরে চিঠি লিখলেন খোদ স্যার আর্থার কোনান ডয়েলকে। অবশ্য এমন নানা মামলায় তদন্তের জন্য ডয়েল আমন্ত্রণ আগেও পেয়েছেন। কিন্তু এই সময় লেখকের সদ্য স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে। আর এমনিতেও ভারতের প্রতি একটা গোপন আকর্ষণ তো ডয়েলের নানা লেখাতেই পাওয়া যায়। হয়তো সেই তাগিদেই তিনি ছুটলেন গ্রেট অয়ারলেতে। বাগানের উইকেট সরিয়ে বারান্দার কাছাকাছি আসতেই তিনি দেখলেন জর্জ সকালের খাবার নিয়ে বসেছেন আর একমনে খবরের কাগজ পড়ছেন। কিন্তু ডয়েল অবাক হলেন, জর্জ কাগজকে ধরেছেন চোখের একেবারে সামনে। কাগজ থেকে চোখ তুলতেই আসল প্রশ্নটা করলেন ডয়েল। আর জর্জ জানালেন, সত্যিই তাঁর দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ। দূরের জিনিস দেখতে পান না। পরে ডয়েল নিজের উদ্যোগে পরীক্ষাও করেন। আর সেইসঙ্গে এটাও প্রমাণ করেন যে পশুহত্যার দোষী আর যেই হোক, জর্জ নয়। কারণ যেদিন তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তার আগের রাতে শ্যাফর্ডশায়ারে প্রবল ঝড়বৃষ্টি হয়। জর্জের মতো ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তির একজন মানুষের পক্ষে সেই অবস্থায় বাইরের কিছুই দেখা সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন
কোনান ডয়েলের চেয়েও বেশি শার্লক-কাহিনি লিখতে চান এই মার্কিন লেখিকা!
ডয়েলের যুক্তির কাছে শেষ পর্যন্ত বিচারক হার মানেন। ১৯১০ সালে লেখক নিজে পুরো ঘটনার বিবরণ লিখেছিলেন টেলিগ্রাফের পাতায়। কিন্তু নিজের একটি ব্যর্থতা কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। লেখক চেয়েছিলেন প্রকৃত অপরাধীকে খুঁজে বের করতে। যেমনটা শার্লক অনায়াসে করে থাকেন। কিন্তু এখানে নিজের তৈরি চরিত্রের কাছেই লেখককে হার মানতে হয়। প্রকৃত অপরাধীর হদিশ তিনি পাননি। এরপরেও বেশ কিছুদিন চলেছিল পশুহত্যা। তবে ডয়েলের পরিচয় গোয়েন্দা কাহিনির লেখক থেকে এবার হয়ে উঠল প্রকৃত গোয়েন্দা। আর সেইসঙ্গে জর্জের সঙ্গে তাঁর গভীর বন্ধুত্বও গড়ে উঠল। পরে নানা সময়ে দুজন দুজনের পারিবারিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকেছেন। পত্রালাপ চলেছে ডয়েলের মৃত্যুর আগে পর্যন্তও। এমন বন্ধুত্বের উদাহরণ সত্যিই বিস্ময়কর।
আরও পড়ুন
ফেলুদার শহরে শার্লক হোমসের ঠেক; ঢুঁ মারতেন সুকুমার সেন, প্রেমেন্দ্র মিত্র, নীরেন্দ্রনাথ, সমরেশ বসুরা
তথ্যসূত্রঃ Why 100 Years Ago, Arthur Conan Doyle Formed An Unlikely Friendship With An Unknown Indian, DIVYA SETHU, The Better India
Powered by Froala Editor