ছোটোবেলায় ঠাকুমার ঝুলির দত্যি-দানো, পরী কিংবা মৎস্যকন্যার গল্প শুনে বড়ো হয়নি, এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। কিন্তু আদতে এসব যে বাস্তব নয়, তা সকলেই জানি আমরা। তা সত্ত্বেও অতিলৌকিক গল্প কিংবা ছবি আকর্ষণ করে প্রাপ্তবয়স্কদেরও। তবে সাধারণ কোনো মানুষ নয়, পরীদের অস্তিত্বের সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল খোদ শার্লকস্রষ্টা আর্থার কোনান ডয়েলের (Arthur Conan Doyle)। এমনকি ১৯২০ সালে রীতিমতো প্রমাণ পেশ করে আস্ত একটি প্রবন্ধও লিখেছিলেন তিনি ‘স্ট্র্যান্ড’ পত্রিকার ক্রিসমাস সংখ্যায়। কিন্তু কীভাবে সন্ধান পেলেন তিনি পরীদের (Fairies)?
এই গল্পের শুরু আরও বছর তিনেক আগে। সেটা ১৯১৭ সাল। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ইংল্যান্ডে ফিরে কটিংলি-তে নতুন বাড়িতে উঠেছিলেন রাইট পরিবার। আদতে ব্যবসার কারণেই দীর্ঘদিন আফ্রিকায় কাটিয়েছিলেন রাইট দম্পতি। যাই হোক, নতুন পরিবেশে রাইট দম্পতি মানিয়ে নিলেও, অসুবিধায় পড়েছিলেন তাঁদের কন্য বছর ষোলোর এলসি। নতুন স্কুল, নতুন প্রতিবেশী, অচেনা পাড়া— চট করে কি মানিয়ে নেওয়া যায়? একমাত্র বন্ধু ছিল তাঁর মাসতুতো বন ফ্রান্সিস গ্রিফিথস। বছর দশের বোনকে সঙ্গী করেই কটিংলি-র জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত এলসি। তবে মেয়ে সারাদিন কী করছে, তা নিয়ে কী দুশ্চিন্তার অভাব আছে বাবা-মায়ের? মাঝে-মধ্যেই রাইট দম্পতির জেরার জবাব দিতে হত এলসি-ফ্রান্সিসকে।
সবই চলছিল ঠিকঠাক। হঠাৎ একদিন এলসি তাঁর বাবা-মাকে জানায়, সে জঙ্গলে একদল নতুন বন্ধু খুঁজে পেয়েছে। তাদের মানুষের মতো দেখতে হলেও, দুটো ডানা আছে প্রজাপতির মতো। তাদের পা পড়ে না মাটিতে। এলসির কথায় সায় দেয় ফ্রান্সিসও। কিন্তু কার কথা বলছে এই কিশোরী? পরী? হ্যাঁ, গল্পের বই-তে পরীদের যে ছবি থাকে, তার সঙ্গেই হুবহু মিলে যাচ্ছে এই বর্ণনা। কিন্তু পরীরা বাস্তবেই আছে নাকি? এককথায় রাইট দম্পতি হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন সন্তানের কথা। তবে অবাক হওয়ার বাকি ছিল বৈকি। রীতিমতো চমকে দিয়েই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বসে এলসি। চাইলেই নাকি সে প্রমাণ দিতে পারে হাতে-নাতে। সেই কথা মতোই বাবার থেকে ক্যামেরাও পেল সে।
এরপর এটা ঘটল তা একেবারেই অকল্পনীয় ছিল রাইট দম্পতির কাছে। ক্যামেরা নেওয়ার দিন দুয়েকের মধ্যেই তা ফিরত দিয়েছিল এলসি। দাবি করেছিল, সে নাকি ছবি তুলে এনেছে পরীদের। স্বাভাবিকভাবেই প্রথমে পাত্তা দেয়নি তাঁর বাবা। তবে ক্যামেরার নেগেটিভ থেকে প্লেট বানিয়েই চমকে যান আর্থার রাইট। এ যে সত্যিই পরী! একটি নয়, দুটি ছবি। প্রথমটিতে দেখা যাচ্ছে, চিবুকে হাত দিয়ে সবুজ পাতার ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে ফুটফুটে একটি ডানাওয়ালা পরী। দ্বিতীয় ছবিটি আরও অবিশ্বাস্য। সামনে থেকে জুম করে ধরা হয়েছে ফ্রান্সিসের হাসিমুখ। আর তাঁর মুখের সামনে উড়ছে চারজন পরী।
আরও পড়ুন
বিশ্বের ইতিহাসে ‘স্মার্টেস্ট’ ক্রিকেট টিম, দলে শার্লক এবং পিটার প্যান-স্রষ্টাও
ঘটনা নাটকীয় মোড় নেয় এর পরে। ১৯১৯ সালে ব্র্যাডফোর্ডের থিওসফিক্যাল সোসাইটিতে হাজির হন এলসির মা অ্যানি। আদতে জাদুবিদ্যা, পরীরা আদৌ সত্যি কিনা, তা জানাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। সেখানে গিয়ে থিওসফিস্ট এডওয়ার্ড গার্ডনারের বক্তৃতায় রীতিমতো বিশ্বাস জন্মায় তাঁর। সাহস করে বক্তৃতার পর মেয়ের তোলা ছবিগুলিও দেখান তিনি। তারপরই সাড়া পড়ে যায় গোটা ব্রিটেনজুড়ে। অলৌকিকতায় বিশ্বাস থাকলেও, পরীদের দেখে রীতিমতো চমকে গিয়েছিলেন গার্ডনার। ছবিগুলির সত্যতা যাচাই করতে ডাক পড়ে তৎকালীন ব্রিটেনের অন্যতম ফটোগ্রাফার হ্যারল্ড স্নেলিং-এর। প্রায় এক সপ্তাহ পরীক্ষার পর স্নেলিং জানান, ছবিগুলি সত্যি। কারণ দুটি ছবিতেই যে পরীটিকে দেখা যাচ্ছে, তা থেকেই স্পষ্ট ডানা নাড়ছে সেটি। দুটি ছবিতে একই পরীর ডানার অবস্থান ভিন্ন। আর ছবি প্রিন্টের সময় পরিবর্তন করা হলেও, নেগেটিভে কারসাজি করার সুযোগ নেই কোনো।
আরও পড়ুন
গাছতলায় ‘মুঘল-এ-আজম’এর গান রেকর্ড; গানের পুস্তিকা লিখেছেন শার্লক হোমসও!
আর পাঁচজন সাধারণ পাঠকদের মতো, খবরের কাগজে এই সংবাদ দেখেছিলেন শার্লকস্রষ্টা স্যার আর্থার কোনান ডয়েলও। অলৌকিকতা, ব্ল্যাক ম্যাজিকে তাঁর বিশ্বাস ছিল বহু আগে থেকেই। এবার এমন এক ঘটনার সন্ধান পেয়ে তিনি মাঠে নামেন রহস্য অনুসন্ধানের। নিজেই যোগাযোগ করেন রাইট পরিবারের সঙ্গে। নিজের চেম্বারে ডেকে পাঠান তাঁদের।
আরও পড়ুন
প্যারাস্যুটে গোপন বার্তা, ‘পার্সিভারেন্স’ রোভারের সঙ্গে জড়িয়ে শার্লক হোমসও!
হ্যাঁ, এলসি-ফ্রান্সিসকে নিয়েই স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের কাছে আর্থার রাইট। এবার একটু শার্লকি চালেই এলসিকে আরও চারটি ছবি তুলে আনার নির্দেশ দেন কোনান ডয়েল। জানান, তিনি নিজেও তাঁদের সঙ্গে যেতে চান পরী-অভিযানে। সময়ের অভাবে কটিংলি কাউন্টিতে যাওয়া না হলেও, আর্থার কোনান ডয়েলকে অবাক করেই কিছুদিন পর তাঁর ঠিকানায় এসেছিল সাদা খামে মোড়া চারটি ঝকঝকে ছবি। হ্যাঁ, পরীর।
তখন অক্টোবর মাস। এই ছবিগুলিকে প্রমাণ হিসাবে পেশ করেই একটি আস্ত গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখে ফেললেন কোনান ডয়েল। বলতে গেলে, তাঁর এই লেখা লুফে নিয়েছিল ‘স্ট্র্যান্ড’ পত্রিকা। হ্যাঁ, এই স্ট্র্যান্ডেই প্রথম প্রকাশ শার্লক হোমসের। স্ট্র্যান্ড থেকেই খ্যাতির শিখরে পৌঁছেছিলেন কোনান ডয়েল। ফলে, ‘দ্য এভিডেন্স ফর ফেয়ারিস’ শীর্ষক তাঁর এই লেখা বেশ ঘটা করেই ছাপা হয় ক্রিসমাস সংখ্যায়। পরবর্তীতে যা তাঁর ‘কামিং অফ দ্য ফেয়ারিস’ (১৯২২) গ্রন্থেও সংকলিত হয়েছে।
আর্থারের এই লেখা যেমন সমাদৃত হয়েছিল একাংশের মধ্যে, তেমনই উঠেছিল সমালোচনার ঝড়। পদার্থবিদ জন-হল এডওয়ার্ড, অলিভার লজ, কবি মরিস হাউলেট-সহ একাধিক ব্যক্তিত্বই সরব হন আর্থারস্রষ্টার বিরুদ্ধে। অভিযোগ ছিল, শার্লক হোমসের মতো চরিত্রের স্রষ্টার কলমে এমন আজগুবি গল্প রীতিমতো অবাস্তবতার জাল বুনবে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। ধ্বংস করবে বিজ্ঞানের মানসিকতাকে। সে-সময় বহু মানুষ পরীদের সন্ধানে কটিংলে-র জঙ্গলে হাজির হলেও দেখা পাননি তাদের। অমীমাংসিত হয়েই রয়ে যায় এই রহস্য।
এর প্রায় এক যুগ পরে যবনিকা পতন হয় এই রহস্যের। ১৯৭০-এর দশকের শুরুতে একটি বেতার অনুষ্ঠানে আসল ঘটনা প্রকাশ্যে আনেন এলসি-ফ্রান্সিস। আদতে তাঁদের উপস্থাপিত পরীরা ছিল নিছকই ছবি। বই-এর ছবি কেটে কার্ডবোর্ডের ওপর সেঁটে পরীদের প্রতিকৃতি তৈরি করেছিলেন তাঁরা। কাচের বাটির মধ্যে সেই প্রতিকৃতি বসাতেই, তা ত্রিমাত্রিক দেখায়। তারপর ক্যামেরার এক্সপোজার বাড়িয়ে এই ছবি তুলেছিলেন এলসি। তাতে পরীদের ছবি উঠলেও অদৃশ্য হয়ে যায় কাচ। তৎকালীন সময়ে ষোড়শী কিশোরীর ক্যামেরায় এহেন দক্ষতা রীতিমতো প্রশংসা করার মতোই। কিন্তু কেন প্রায় ৫০ বছর এই সত্য গোপন করেছিলেন তিনি?
এক কথায় উত্তর ‘ভয়’। হ্যাঁ, প্রাথমিকভাবে বাবা-মায়ের সঙ্গে মজা করাই ছিল দুই কিশোরীর উদ্দেশ্য। তবে তাঁদের এই মজাকে যে সত্যি ভেবে নেবে তা বুঝতে পারেননি এলসি। বিশেষত এই খবর সংবাদপত্রে বেরিয়ে যাওয়ার পর রীতিমতো ভয় পেয়ে গেছিলেন তিনি। আসল সত্যি প্রকাশ্যে আনলে যে বাবা-মা মিথ্যুক হয়ে যাবে গোটা দুনিয়ার কাছে। অপদস্ত হতে হবে তাঁদের। তাই বাবা-মায়ের মৃত্যু পর্যন্ত আজীবন গোপন রেখেছিলেন এই কথা। তবে মানতেই হয়, তাঁদের এই নিতান্ত ছলনার জাল ছিঁড়তেও ভিমরি খেয়েছিলেন দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দার জনক…
Powered by Froala Editor