রাস্তায় তরুণীর গলাকাটা দেহ, তদন্তে কলকাতার প্রথম 'ডিটেকটিভ'

১৮৬৮ সালের পয়লা এপ্রিল। তখন কলকাতার চেহারা আজকের মতো ছিল না। ইংরেজরা একটু একটু করে তৈরি করছে তাঁদের প্রাণের রাজধানীকে। তবুও রাতের বেলাটা শুনশান, বেরোতেও ভয় করে। এমনই এক রাতে টহল দিচ্ছে একজন পুলিশ। কাছেই আমহার্স্ট স্ট্রিট থানার আলো দেখা যাচ্ছে। বসন্তের হাওয়া এখনও যায়নি। বেশ নিশ্চিন্ত মনেই হাঁটছিল ওই পুলিশ। হঠাৎ টনক নড়ল তাঁর। একটু দূরে রাস্তার ধারেই কিছু একটা বস্তা মতো পড়ে আছে মনে হচ্ছে। সন্দেহ হতে সেদিকে এগিয়ে গেল সে। বস্তা নয়; সাদা কাপড়ে মোড়ানো কিছু একটা। আরেকটু কাছে যেতেই চমকে উঠল পুলিশটি। কিছুক্ষণ নিজেকে সামলে দৌড় দিল থানার দিকে। সে দেখতে পেয়েছে, সাদা কাপড়ের গায়ে লেগে আছে টাটকা রক্ত। আর ভেতর থেকে বেরিয়ে আছে একটি দেহ— এক তরুণীর নিথর, গলাকাটা দেহ… 

কয়েক বছর আগেই লর্ড ডালহৌসি কলকাতা পুলিশের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। একটু একটু করে পুলিশি ব্যবস্থাকে গোছানোর চেষ্টা চলছে। তার মধ্যেই এমন একটি ঘটনা! পুলিশমহলে চাঞ্চল্য পড়ে গেল। শুধু পুলিশ মহলেই নয়; কলকাতার প্রতিটা জায়গায় শুরু হল জল্পনা। খবরের কাগজগুলিতে বেরিয়েছে ঘটনা ও মৃতদেহের বর্ণনা। মেয়েটির গলা কাটা, মুখ খোলা, চোখদুটো ঠিকরে বাইরে বেরিয়ে আসছে। একটি হাত কোমরের পেছনে বেঁধে রাখা। আর ঘটনাস্থল ভেসে যাচ্ছে রক্তে। এমন বীভৎস দৃশ্য দেখে এবং পড়ে শিউরে উঠছেন সবাই। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, এটা খুন। কিন্তু এভাবে কলকাতার রাস্তায় কাউকে খুন করে ফেলে রাখার ঘটনা তো সেভাবে ঘটেনি! যা হয়েছে সেসব গুন্ডা-ডাকাতদের মারামারি অথবা রাজনৈতিক হত্যার ঘটনা। অনেক সময় বেহেড মাতালদের দেহও এভাবে পড়ে থাকতে দেখা যায়। কিন্তু তাই বলে এমন অল্পবয়সী মেয়েকে খুন? 

নড়ে চড়ে বসল কলকাতা পুলিশ। তখন পুলিশ কমিশনারের জায়গায় স্টুয়ার্ট হগ। তাঁর নির্দেশে বিশেষ একটি দল গঠন করা হল। আর এই পুরো ঘটনার তদন্ত করার প্রধান দায়িত্ব দেওয়া হল রিচার্ড রীডকে। ক্ষুরধার বুদ্ধি, সাহসী এবং তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার জন্য হগসাহেবের প্রিয় অফিসার ছিলেন তিনি। শুরু হল ‘আমহার্স্ট স্ট্রিট হত্যা রহস্য’-র তদন্ত। এই গল্প মূলত তাঁকে কেন্দ্র করেই বেড়ে উঠবে এবার। যাই হোক, তদন্তে এসে রীডসাহেব প্রথমেই তরুণীর পরিচয় জানার চেষ্টা শুরু করলেন। উল্লেখ্য, এই হত্যাকাণ্ডেই প্রথমবার এভিডেন্স ফটোগ্রাফিকে তদন্তপ্রক্রিয়ায় যুক্ত করা হয়। রিচার্ড রীড প্রথমেই বুঝলেন, এই তরুণী একজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। অসম্ভব সুন্দরী, বয়স খুব বেশি হলে কুড়ি-বাইশের মধ্যেই হবে। কিন্তু কে এই তরুণী? কীভাবে মারা গেলেন? উঠে পড়ে লাগলেন রীড।  

দেহ দেখে বেশ কয়েকটি জিনিসের দিকে চোখ গেল তাঁর। প্রথমত যেভাবে গলাটা কাটা হয়েছে, তা একটি বিশেষ ধরণের ছুরির সাহায্যেই করা হয়েছে। সাধারণত যাকে ‘সেলর’স নাইফ’ বলা হয়। দ্বিতীয়ত, তরুণীর পায়ে চটি বা জুতো কিছু ছিল না। আর পায়ের পাতায় মাটি, ধুলো কিছুই লেগে ছিল না। একেবারে পরিষ্কার পা। তাহলে তো ইনি রাস্তায় হাঁটছিলেন না। তাহলে কি খুন অন্য জায়গায় হয়েছে, তারপর দেহ এনে আমহার্স্ট স্ট্রিট চত্বরে ফেলা হয়েছে? সন্দেহ সেইদিকেই জোরালো হচ্ছে। সেইসঙ্গে আরও একটি জিনিসের দিকে নজর রেখেছিলেন রিচার্ড রীড। এই হত্যাকাণ্ডের আগে, ১৮৬৮ সালেই আরও পাঁচজন মহিলাকে খুন করা হয়। তার মধ্যে তিনজন বারবণিতা। এই হত্যার সঙ্গে কি আগের খুনগুলোর কোনো যোগ আছে? রীড ঠিক করলেন, মেয়েটির মৃতদেহের ছবি শহরের সর্বত্র ছড়িয়ে দেবেন। কেউ না কেউ তো ঠিকই চিনতে পারবেন এঁকে। এর আগে এমন পদ্ধতির প্রয়োগ ভারতে হয়নি। 

কেটে গেল বেশ কয়েক সপ্তাহ। এখনও কেউ মেয়েটির সম্পর্কে খোঁজ করতে থানায় এল না। সবাই অধৈর্য হয়ে পড়ছেন। রীডসাহেব অবশ্য শান্ত হয়ে অপেক্ষা করছেন। হঠাৎ দেখা গেল আলোর সন্ধান। একদিন মিঃ হ্যারিস বলে একজন হাজির হলেন থানায়; নিবাস বৈঠকখানা রোডে। বললেন, ছবির মেয়েটিকে চিনতে পেরেছেন তিনি। ওঁর নাম রোজ ব্রাউন। খ্রিস্টান, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। বয়সের ব্যাপারটাও ঠিকই আন্দাজ করেছিলেন রীড। এবং আরও আশ্চর্যের, এই মেয়েটিও বারবণিতা। তবে এখানেই থেমে থাকল না ব্যাপারটা। হ্যারিস বলে ভদ্রলোক জানালেন, মাধবচন্দ্র দত্ত বলে কোনো একজনের সঙ্গে নাকি বেশ কয়েকবার দেখেছেন রোজ ব্রাউনকে। 

এই ‘মাধবচন্দ্র দত্ত’-এর ঠিকানা বের করতে দেরি হল না বেশি। বউবাজারে তাঁর দোকান। সেখান থেকেই গ্রেফতার করা হল তাঁকে। সেইসঙ্গে রীড এবং বাকি পুলিশের হাতে উঠে এল আরও একটি তথ্য। রোজ ব্রাউন নাকি প্রায়শই হাওড়ায় কারোর একটা বাড়িতে যেতেন। কার বাড়ি? ‘যেখানে দেখিবে ছাই…’। জানা গেল, কিংসলে নামের এক গুন্ডার সঙ্গে নাকি একটা সম্পর্ক ছিল রোজের। ওঁর বাড়িতেই নাকি থাকতেন একটা সময়। তবে খুন হওয়ার মাসকয়েক আগে সেখান থেকে চলে আসেন তিনি। তাঁর এও ভয় ছিল, কিংসলে তাঁকে বাঁচতে দেবে না। 

আরও পড়ুন
কলকাতার প্রাচীনতম রাস্তার সঙ্গে জড়িয়ে বর্গি আক্রমণের ইতিহাস

যথারীতি হাওড়ায় হানা দিল কলকাতা পুলিশের একটি দল। কিংসলের বাড়ি তে গিয়ে দেখা গেল, পাখি ফুড়ুৎ! ভেতরে একটি জামা, কিছু মেয়েদের জামাকাপড় পড়ে আছে। আর সেই জামাকাপড়ে রক্তের দাগ! রহস্যের গন্ধ প্রকট হচ্ছে। আরেকটু খুঁজে দেখা যাক! শেষমেশ একটি চাবি ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়নি। কিংসলে’র ওপরেই সন্দেহ গাঢ় হল সবার। তাঁকে ধরার জন্য সব জায়গায় জাল ছড়ালেন রীড। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, সে যেন গায়েবই হয়ে গেছে! তবে তদন্তের শেষ দেখে ছাড়লেন রিচার্ড রীড। তিনিও যে দক্ষ খেলোয়াড়! 

এই তদন্তই রিচার্ড রীডকে অন্য স্তরে নিয়ে গেল। কমিশনার স্টুয়ার্ট হগ বুঝলেন, কলকাতা পুলিশের বাইরেও এই গোয়েন্দা বাহিনীকে কাজে লাগাবেন। ১৮৬৮ সালেরই নভেম্বর মাসে চালু হল কলকাতা পুলিশের আলাদা একটি ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট। পরবর্তীকালে যার সুপারিনটেনডেন্টের দায়িত্বও পেয়েছিলেন রিচার্ড রীড। একের পর এক তদন্তের সমাধান করে তিনি তখব ভারতের গোয়েন্দা সেনসেশন। বলা ভালো, রিচার্ড রীডই ছিলেন খাতায় কলমে কলকাতা শহরের প্রথম গোয়েন্দা। ব্যোমকেশ, ফেলুদা, কিরীটীদেরও বহু আগে… 

শেষ করার আগে একটা ছোট্ট কথা বলে নেওয়া ভালো। পুলিশের কাজ করতে করতে অনেক গোয়েন্দা অফিসারকেই নানা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়। এক একটা ঘটনা গায়ের রোম খাঁড়া করে দেয়। তাঁদের অনেকেই নিজেদের অভিজ্ঞতা, তদন্ত প্রক্রিয়া লিখে রেখেছিলেন। এই কথা বলতে গিয়ে আমাদের মনে পড়বে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় এবং তাঁর ‘দারোগার দপ্তর’-এর কথা। কলকাতার প্রথম মহিলা সিরিয়াল কিলারের তদন্তপ্রক্রিয়াও সেখানে উঠে এসেছে। তাঁরও আগে রিচার্ড রীডও এমন কাজ করেছিলেন। নিজের গোয়েন্দা জীবনের সমস্ত ঘটনা লিখেছিলেন ‘এভরি ম্যান হিস ওন ডিটেকটিভ’ বইতে। রোজ ব্রাউনের হত্যারহস্যের উল্লেখও পাওয়া যায় সেখানে। যার পরতে পরতে হেঁটে বেড়ায় পুরনো, গা ছমছমে কলকাতা আর এক দুর্ধর্ষ ইংরেজ ডিটেকটিভ। শহরের প্রথম ডিটেকটিভ…               

আরও পড়ুন
রহস্যময় বাঁকাউল্লা ও বাংলার প্রথম গোয়েন্দাকাহিনি

তথ্যসূত্র-
১) ‘কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ’, সব বাংলায়
২) ‘কলকাতার প্রথম গোয়েন্দার খুনের কিনারা’, কমলেন্দু সরকার, সেন্টুর নেটওয়ার্ক
৩) ‘The Amherst Street murder and Calcutta’s real-life Sherlock Holmes’, Devasis Chattopadhyay, Live History India 

Powered by Froala Editor

More From Author See More