শীতকালীন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। সেজে উঠেছে বেজিং-এর দ্য বার্ডস নেস্ট স্টেডিয়াম। স্টেডিয়ামের কেন্দ্রে ছোটো ছোটো দল হিসাবে দাঁড়িয়ে রয়েছেন বিভিন্ন দেশ থেকে আগত প্রতিযোগীরা। এই ভিড়ের মধ্যে তাঁকে দলছুট মনে হওয়াই স্বাভাবিক। তিনি আরিফ খান (Arif Khan)। না, কোনো সহ-খেলোয়াড় বা সহ-প্রতিনিধি নেই তাঁর। ভারতের পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনি একাই। ক্রীড়াক্ষেত্রের দিক থেকেই হোক কিংবা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে— বেজিং অলিম্পিক গেমসে ভারতের একমাত্র প্রতিযোগী তিনি। অলিম্পিকে প্রথম ভারতীয় স্কিয়ারও বটে। বলতে গেলে একক প্রচেষ্টাতেই তিনি ভারতকে তুলে এনেছেন উইন্টার অলিম্পিকের (Winter Olympics) মঞ্চে।
হ্যাঁ, একক প্রচেষ্টাতেই। কারণ, দেশের প্রশাসন কিংবা জাতীয় ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানগুলির থেকে সেই অর্থে কোনো সাহায্যই পাননি তিনি। কাজেই বলার অপেক্ষা থাকে না, এই লড়াই খুব সহজ ছিল না তাঁর কাছে।
কাশ্মীরের গুলমার্গের এক দরিদ্র পরিবারে বড়ো হয়ে ওঠা আরিফের। বাবা ছিলেন স্কিইং গাইড। শীত পড়লেই গুলমার্গ ঢেকে যায় শ্বেতশুভ্র বরফের চাদরে। আর এই মনোরম পরিবেশে শখের স্কিইং ও স্কেটিং করতে ভিড় জমান হাজার হাজার মানুষ। এই সময়টার ওপরেই নির্ভর করে থাকে আরিফের পরিবার। তাছাড়া একটা ছোটো স্কিইং সামগ্রী বিক্রির দোকান আছে বটে। তবে সারাবছর তাতে বিক্রি হয় না বললেই চলে।
মাত্র চার বছর বয়সে বাবার কাছেই স্কিইং-এ হাতেখড়ি আরিফের। তারপর ধীরে ধীরে প্রবেশ করা পেশাদার খেলার জগতে। প্রথম কোনো বড়ো সাফল্য মেলে ২০০৫ সালে। জাতীয় মিটে সোনা আনেন আরিফ। আরও চার বছর পর আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় আত্মপ্রকাশ। তবে সবটাই আরিফকে করতে হয়েছে নিজের গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে। সেইসঙ্গে অনুশীলনের অসুবিধা তো ছিলই। শীতকালের সময়টুকুই শুধু বরফ পেতেন আরিফ। বাকি সময়টায় প্রশিক্ষণ নেওয়া কিংবা অনুশীলনের সুযোগ ছিল না বললেই চলে।
আরও পড়ুন
কাশ্মিরে তৈরি ভারতের প্রথম ইগলু ক্যাফে, বিশ্বের বৃহত্তম
তবে আজ থেকে আড়াই দশক আগেও এমন পরিস্থিতি ছিল না ভারতে। উইন্টার গেমসের জন্য ছিল বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। ১৯৯৮ সালে শীতকালীন সমস্ত খেলাকে অগ্রাধিকারের তালিকা থেকে বাতিল করে ভারত সরকার। তারপর আর নতুন করে পুনর্স্থাপিত হয়নি শীতপ্রধান খেলাধুলোর ফেডারেশন। ফলে, ভারতের শীতকালীন খেলায় আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের পরিমাণও এসে ঠেকে তলানিতে।
আরও পড়ুন
কাশ্মিরের প্রথম মহিলা হুইলচেয়ার বাস্কেটবল খেলোয়াড়, স্বপ্ন দেখাচ্ছেন বাসির
২০১৮ সালেই অলিম্পিকে খেলার সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল আরিফের কাছে। উইন্টার অলিম্পিকে অংশ নিতে গেলে, যোগ্যতা অর্জন করতে হয় পাঁচটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়। তার মধ্যে চারটি বাধাই অতিক্রম করে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পঞ্চমটি আর সম্ভব হয়নি অর্থের অভাবে। হ্যাঁ, প্রতিযোগীর তালিকাতে তাঁর নাম থাকলেও, অর্থের অভাবে বিদেশভ্রমণ করতে পারেননি তিনি।
আরও পড়ুন
চরম অবহেলায় ধুঁকছে কাশ্মিরের প্রথম প্রকাশনা সংস্থা
চলতি অলিম্পিকে অংশগ্রহণের আগেও সেই একই প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল আরিফকে। ২০২০ সালে আন্তর্জাতিক স্কি ফেডারেশন ভারতের স্কি ও স্নোবোর্ডের খেলোয়াড় সংগঠনকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিলেও বদলায়নি পরিস্থিতি। ক্রাউড ফান্ডিং-এর মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করেই বিদেশে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হয়েছে তাঁকে। সমস্ত সঞ্চয় খুইয়ে দিনের পর দিন অনুশীলন করতে হয়েছে দুবাইয়ের কৃত্রিম স্কিইং গ্রাউন্ডে। আরিফের অভিমত, অলিম্পিকের যোগ্যতা অর্জন করা, দেশের হয়ে অলিম্পিকের মঞ্চে প্রতিনিধিত্ব করাই তাঁর কেরিয়ারের শ্রেষ্ঠ সাফল্য। জয় কি আসবে? সেই উত্তর দেবে সময়ই। তবে আরিফের এই লড়াই হাজার হাজার কাশ্মিরি তরুণের কাছে অনুপ্রেরণা। তাঁর দিকে তাকিয়েই স্বপ্ন বুনছে গোটা দেশ…
Powered by Froala Editor