১১ ডিসেম্বর। কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচে সেদিন ফ্রান্সের কাছে ২-১ গোলে পর্যুদস্ত হয়েছিল ইংল্যান্ড। অথচ, সেই ‘শত্রুপক্ষ’ ফ্রান্সের হয়েই বিশ্বকাপ ফাইনালে গলা ফাটিয়েছিলেন গোটা ইংল্যান্ডের ফুটবল সমর্থকরা! ফ্রান্সের সমর্থনে টুইটারের বন্যা বইয়েছিলেন ইংলিশরা।
হ্যাঁ, ব্যাপারটা খানিক অদ্ভুত লাগলেও সত্যি। ১৯৮৬ সাল। সেবার মারাদোনার নেতৃত্বে বিশ্বকাপ জয় শুধু ফুটবল-বিপ্লবই ছিল না আর্জেন্টিনার (Argentina), ছিল ফকল্যান্ড যুদ্ধের (Falkland War) অলিখিত প্রতিশোধ। ৪০ বছর আগের যে যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিলেন বহু আর্জেন্টাইন। ফকল্যান্ড দ্বীপ তো বটেই, এমনকি আর্জেন্টনার মূল ভূখণ্ডেও নির্বিচারে বোমা বর্ষণ করেছিল ইংল্যান্ড (England)। তবে ফকল্যান্ড দ্বীপ নিয়ে দুই রাষ্ট্রের মধ্যে বিবাদ থামেনি আজও। আজও স্বাক্ষরিত হয়নি কোনো শান্তিচুক্তি। তবে এই রাজনৈতিক যুদ্ধের ছায়া এবার শুরু থেকেই দেখা গিয়েছিল বিশ্বকাপের ময়দানে।
এই আগুনে ঘৃতাহুতি পড়ে ক্রোয়েশিয়াকে হারিয়ে আর্জেন্টিনার সেমিফাইনালে জয়ের পরই। ড্রেসিং রুমে সেদিন গান ধরেছিলেন মার্তিনেজ, আলভারেজ, অটামেন্ডিরা। না, নতুন কোনো গান নয়, আর্জেন্টাইন ফ্যানেদের লেখা এই গান বাজারে চলছে ২০১৮ সাল থেকে। কদর্য ভাষায় খোলাখুলিভাবে যে গানে গালমন্দ করা হয়েছে ইংল্যান্ডকে। উল্লেখিত হয়েছে ফকল্যান্ড যুদ্ধের কথা। বাদ যায়নি ‘পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল’-ও। বিশ্বকাপ চলাকালীন সময়ে এই গানের বুলি মন্ত্রোচ্চারণের মতো আওড়াতে শোনা গিয়েছিল গ্যালারিতে বসা আর্জেন্টাইন সমর্থকদেরও। তবে সেমিফাইনালের ড্রেসিংরুমে খোদ আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়দের মুখে এই গান শুনে অবাক হয়েছিলেন অনেকেই। মার্তিনেজ, অটামেন্ডিদের এই ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ্যে আসতেই শুরু হয় বিতর্ক। ‘শত্রুর শত্রু, আমার মিত্র’— খানিকটা যেন এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই ইংলিশরা ভিড়েছিলেন ফ্রান্স শিবিরের সমর্থনে।
অবশ্য এখানেই থেমে থাকেনি ইংলিশ-আর্জেন্টাইন দ্বন্দ্ব। বিতর্ক শুরু হয়েছিল ইংলিশ রেফারি এন্থনি টেলরকে নিয়েও। প্রাথমিকভাবে ২০২২ বিশ্বকাপ ফাইনালে ম্যাচ পরিচালনার জন্য তাঁর কথাই ভেবেছিল ফিফা। ২০১০ সালের ফাইনালের পর এই প্রথম বিশ্বকাপ ফাইনাল পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন কোনো ইংল্যান্ডের রেফারি। তবে আর্জেন্টাইনার অভিযোগ ছিল, ফাইনালে পক্ষপাতিত্ব করতে পারেন তিনি। সেই অভিযোগের ভিত্তিতেই রেফারি বদল করে ফিফা। দায়িত্ব পান পোল্যান্ডের সিমন মার্সিনিয়াক।
এসবের মধ্যেই ফাইনালের দিনও ফের শোনা গিয়েছিল বিতর্কিত স্প্যানিশ গানটি। এমনকি স্পটিফাই-এর সবচেয়ে জনপ্রিয় গানের তালিকায় শীর্ষে উঠে আসে এই গান। স্বাভাবিকভাবেই আর্জেন্টিনা ও সর্বোপরি মেসির বিশ্বজয়ের বর্ণময় সন্ধ্যায় ফের একবার বিতর্কের দানা বাঁধে এই গান নিয়ে। কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়দের স্পোর্টিং স্পিরিটকে।
তবে এখানেই শেষ নয়। আর্জেন্টনার এই জয় আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনৈতিক সমীকরণে বড়োসড় বদল আনতে পারে আগামীদিনে, এমনই অভিমত অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের। কারণটাও খুবই স্পষ্ট। গতকাল বিশ্বের বিভিন্ন মিত্র-দেশে আর্জেন্টাইন রাষ্ট্রদূতরা আয়োজন করেছিলেন বিশেষ ফাংশনের। তাঁদের বক্তৃতায় একাধিকবার উঠে এসেছিল ফকল্যান্ড যুদ্ধের কথা। বাদ যায়নি ভারতও। আর্জেন্টিনা ২ গোলে এগিয়ে যাওয়ার পরই, দিল্লির দূতাবাসে আর্জেন্টাইন অ্যাম্বাস্যাডর হুগো জাভিয়ের গোবি-ও এদিন প্রসঙ্গ তোলেন। সবমিলিয়ে বিশ্বকাপ জয়কে কেন্দ্র করে ফকল্যান্ড দ্বীপের ক্ষমতা পেতে নতুন উদ্যমে ঝাঁপাতে চাইছে আর্জেন্টিনা।
আদতে স্ট্র্যাটেজিক অবস্থানই নয়, ফকল্যান্ড দ্বীপে লুকিয়ে রয়েছে পেট্রোলিয়ামের ভাণ্ডার। আর প্রাকৃতিক তেলের অধিকার কার কপালে জুটবে শেষ পর্যন্ত— তা নিয়েই বিবাদ ত্বরান্বিত হয়ে চলেছে এই দুই দেশের। আর্জেন্টিনার বিশ্বজয়ের মধ্যেই সে-দেশে মূল্যবৃদ্ধি ছুঁয়েছে ৯৭ শতাংশের রেকর্ড মাত্রা। এমত অবস্থায় ফকল্যান্ডের ক্ষমতা ফিরে পেলে অর্থনৈতিক দিক থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হবে লাতিন আমেরিকার দেশটি, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। সবমিলিয়ে মেসিদের বিশ্বজয়কে সামনে রেখেই ভাগ্য-বদলের চেষ্টা করছে গোটা দেশ।
ফকল্যান্ড-বিবাদ নিয়ে আগামীতে রাষ্ট্রপুঞ্জেও সরব হবে আর্জেন্টনা, ইতিমধ্যেই তা আগাম জানিয়েছে সেখানকার প্রশাসন। সাহায্য চেয়েছে মিত্র-শক্তিদেরও। কোন দেশ কার পক্ষে যাবে, তা নিয়েই শুরুও হয়ে গেছে কূটনৈতিক হিসেব-নিকেশ। তবে ফের সামরিক যুদ্ধের ময়দানে পা না দিয়ে, আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান খুঁজবে আর্জেন্টিনা ও ইংল্যান্ড, পুনরাবৃত্তি হবে না রক্তাক্ত ইতিহাসের— এমনটাই তো চাওয়া উচিত যে-কোনো বিশ্ববাসীর…
Powered by Froala Editor