সমুদ্র সৈকতজুড়ে হঠাৎই জনস্রোত। না, কোনো উৎসব নয়। তাঁরা পর্যটকও নন। শুধু আশ্রয় পাওয়ার আশাতেই কয়েক মাইল পথ, সমুদ্রে সাঁতর কেটে হাজির হয়েছেন তাঁরা। গত পরশুই মরক্কো থেকেই স্পেনের কিউটা অঞ্চলে প্রবেশ করেন প্রায় ছ’হাজার শরণার্থী। যার মধ্যে রয়েছে অন্ততপক্ষে দেড় হাজারেরও বেশি শিশু। আর তা নিয়েই বেশ বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে স্পেনের উপকূলে। স্পেনের প্রশাসন স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, অর্ধেক শরণার্থীকেই ফিরিয়ে দেওয়া হবে মরক্কোয়।
১৭ শতাব্দী থেকেই কিউটা স্পেনের ক্ষমতাধীন। তবে দীর্ঘদিন ধরেই মেলিল্লা এবং এই অঞ্চলটির দাবি জানিয়ে আসছে মরক্কো। সম্প্রতি প্রকাশ পাওয়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে শরণার্থীদের স্পেনে প্রবেশের জন্য সীমান্তপথ খুলে দিয়েছিল মরক্কোর সেনারা। তা নিয়েই দুই দেশের মধ্যে সংশয় তৈরি হয়েছে নতুন করে। কিন্তু এই অভিবাসনের কারণ কী? পরিসংখ্যান বলছে মরক্কোর ৯৯ শতাংশ নাগরিকই ইসলাম ধর্মাবলম্বী। চল্লিশের দশকে সেখানে ইহুদিদের জনসংখ্যা ছিল ১০ শতাংশ। তা কমতে কমতে এসে দাঁড়িয়েছে ১ শতাংশে। ফলে সাম্প্রদায়িক হিংসা তো রয়েইছে। পাশাপাশি আর্থিক সংকটও এই অভিবাসনের একটি বড়ো কারণ।
শুধু মরক্কো-স্পেন সীমান্তে এমন ছবি নয়। কিছুদিন আগে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তেও ভিড় করেছিল হাজার হাজার শরণার্থী শিশু। কারোর সঙ্গেই নেই অভিভাবক। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি থেকে শিশুদের প্রাণ বাঁচাতেই এমন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন মেক্সিকান অভিভাবকরা। একই ছবি সিরিয়াতেও। অন্যদিকে ভারত-বাংলাদেশ-মায়ানমারে এখনও মেটেনি রোহিঙ্গা সমস্যা।
এক শতাব্দী সময় পিছিয়ে যাওয়া যাক। ১৯১৮ সাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষের পথে। গোটা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল স্প্যানিশ ফ্লু মহামারী। যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি নয় বাদই দেওয়া গেল। শুধুমাত্র সেই মহামারীই প্রাণ কেড়েছিল ১০ কোটি মানুষের। আর সারা পৃথিবীতে সেই মহামারীর ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ ছিল অভিবাসন। সেই ঘটনারই যেন পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে এবার। যেখানে বিশ্বায়নের সময়ে দাঁড়িয়েও করোনাভাইরাসের কারণে থমকে রয়েছে আন্তর্জাতিক পরিবহন, সেখানে অভিবাসন যে নতুন করে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে তাতে নতুন কিছুই নেই। কিন্তু উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, তাঁদের বাধ্য করা হচ্ছে অভিবাসনের পথ বেছে নিতে। সাধারণ মানুষের অসহিষ্ণুতাই প্রশস্ত করছে এই পথ।
আরও পড়ুন
স্বৈরাচারের প্রতিবাদ করায় কবিকে নির্মম হত্যা মায়ানমারে
তবে শুধুই কি অভিবাসন? একাধিক সমস্যায় জর্জরিত নীলগ্রহ। অসহিষ্ণুতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যে গোটা বিশ্বের মানচিত্রজুড়েই চলছে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। গতকাল যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হলেও, ইজরায়েল-প্যালেস্তাইনে যুদ্ধের কারণে আক্রান্ত হাজার হাজার সাধারণ নাগরিক। প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ২৪৪ জন। তেমনই উত্তপ্ত আজারবাইজানের পরিস্থিতিও। রাশিয়া-ইউক্রেনের দ্বন্দ্বে নিয়মিত প্রাণ যাচ্ছে কোনো না কোনো সৈনিকের। কখনো মারা যাচ্ছেন নিরীহ নাগরিকরাও। সেই তালিকাতে রয়েছে আফগানিস্তানেও। মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই ক্রমশ বেড়ে চলেছে জঙ্গি সংগঠনের সক্রিয় কার্যকলাপ। সার্বিকভাবেই যেন বিঘ্নিত গোটা পৃথিবীর ভারসাম্য।
আরও পড়ুন
ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষের কবলে ইথিওপিয়া, বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ, চলছে ‘মিলিটারি-শাসন’ও
এসবের মধ্যে দাঁড়িয়েই নতুন করা মাথা চাড়া দিচ্ছে স্বৈরাচার। একদিকে যেমন মায়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের ফলে অশান্ত গোটা দেশ, চলছে নির্মম হত্যালীলা। তেমনই পাল্লা দিয়ে নৃশংস কাণ্ডকারখানা চলছে বেলারুসেও। কোন দিকে যাচ্ছে গোটা বিশ্বের পরিস্থিতি? সেই প্রশ্নই ঘুরে ফিরে আসছে বার বার।
আরও পড়ুন
চরমতম দুর্ভিক্ষ সুদানে, খিদের জ্বালায় মৃত্যুমুখে অসংখ্য শিশু
মানুষের এই ক্রিয়াকলাপের পরোক্ষ প্রভাব পড়ছে পরিবেশেও। বদলাচ্ছে জলবায়ু। যা ডেকে আনছে আরও গুরুতর বিপদ। কিছুদিন আগেই নাসার একটি গবেষণায় দাবি করা হয়, সরে যাচ্ছে ক্রান্তীয় বৃষ্টি রেখা। কোথাও আকস্মিক বৃষ্টির মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে বন্য। আবার কোথাও হঠাৎ-ই বৃষ্টি কমে যাওয়ায় দেখা দিচ্ছে খরা। যার ফলে তৈরি হচ্ছে খাদ্যসংকট, দুর্ভিক্ষ। সুদান, চাদ-সহ একাধিক আফ্রিকান দেশই চরমতম দুর্ভিক্ষের শিকার। প্রাণ বাঁচাতে, অর্থের খোঁজে অনেকেই পালিয়ে যাচ্ছেন সেখান থেকে। রাস্তা সেই অভিবাসন। সাম্প্রতিক সময়ে এভাবেই যেন একটা সম্পূর্ণ চক্রের মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে পড়েছে মানব সভ্যতা।
সার্বিক পৃথিবীর এই সংকট কি ইঙ্গিত দিচ্ছে শেষের দিকেই এগিয়ে চলেছে মানব সভ্যতা? তেমনটা হলে, আশ্চর্য হবে না কেউই। কারণ, ইতিমধ্যেই গবেষকরা সতর্ক করেছেন ষষ্ঠ গণ-অবলুপ্তির মধ্যে দিয়েই যাচ্ছে বর্তমান সময়। একের পর এক প্রাণীর অস্তিত্ব পৃথিবী থেকে মুছে যাওয়া জানান দিচ্ছে, নষ্ট হয়ে গেছে পৃথিবীর ভারসাম্য। আর এ-কথা অস্বীকার করার জায়গা নেই যে সামগ্রিকভাবে বিপর্যস্ত মানবসভ্যতা। আর বিশ্বব্যাপী এই সহিংসতার ছবিও হুবহু মিলে যায় ডারউইনের তত্ত্ব তথা অস্তিত্বের জন্য সংগ্রামের সঙ্গে। ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’ তত্ত্বের মডেলে বর্তমান পরিস্থিতিকে দিলে দেখা যাবে আরও বাড়তে চলেছে সংকট। আর তারপরেই মুছে যাওয়ার কথা মানবসভ্যতার। এখন দেখার, ডারউইনের এই তত্ত্বই সত্যি হয়ে দাঁড়ায় কিনা। সেই আশঙ্কারই প্রহর গুনছে নীলগ্রহ…
Powered by Froala Editor