যতদূর দেখা যায় শুধু বালি আর বালি। আর তার মধ্যেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে কয়েকটি জাহাজ এবং স্টিমার। জং ধরা জীর্ণ চেহারা তাদের। এই মরুভূমির মধ্যে কোথা থেকে এসে হাজির হল এই জাহাজগুলি? আসলে কয়েক দশক আগেও গোটা অঞ্চলের ছবিটা ছিল একেবারে ভিন্ন। আজ যেখানে মরুভূমি, কয়েক দশক আগে সেটাই ছিল জীবন্ত সমুদ্র। যার আয়তন ছিল প্রায় ৬৮ হাজার বর্গকিলোমিটার। বর্তমানে তার এক দশমাংশও অবশিষ্ট নেই। আর এই ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য দায়ী মানব সভ্যতাই!
হ্যাঁ, উজবেকিস্তানের আরাল সমুদ্রের কথাই হচ্ছে। ষাটের দশকে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম হ্রদ হিসাবেই ধরা হত আরাল সাগর। কিন্তু আয়তনে বঙ্গোপসাগরের প্রায় এক তৃতীয়াংশ এই হ্রদ হঠাৎ শুকিয়ে গেল কীভাবে? আরালের ভৌগলিক অবস্থান দেখলেই পাওয়া যাবে সেই উত্তর। মধ্য এশিয়ার দুই বৃহত্তম নদী হল সির ডায়রা ও আমু ডায়রা। রাশিয়ার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত সির ডায়রা নদীটিই ছিল আরাল সমুদ্রের জলের প্রধান উৎস।
সত্তর দশকের একেবারে শুরুর দিক সেটা। তুলা চাষের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য আমু ডায়রার গতিপথ পরিবর্তন করে সোভিয়েত রাশিয়া। আর তার ফলে, বন্ধ হয়ে যায় আরাল সাগরে জলের প্রবাহ। কিন্তু আবদ্ধ জলাধার আর কতক্ষণই বা টিকিয়ে রাখতে পারে তার প্রাণ! বছর দশেকের মধ্যেই ধীরে ধীরে চোখে পড়তে শুরু করে পরিবর্তন। আবদ্ধ জল ক্রমশ বাষ্পীভূত হওয়ার কারণে, আয়তন কমতে থাকে আরাল সাগরের। একুশ শতকের শুরুতে শুকিয়ে যায় আরাল সাগরের প্রায় এক তৃতীয়াংশ। বিগত বছরগুলিতে আরও দ্রুত গতিতে হারিয়ে যাচ্ছে অবশিষ্টাংশের অস্তিত্ব।
যেখানে একসময় ৭ হাজার ঘন কিলোমিটার জল ছিল আরালে, বর্তমানে এই পরিমাণটা এসে ঠেকেছে মাত্র ৭০ ঘন কিলোমিটারে। আর যেটুকু জল বেঁচে আছে, সেটাও বিষাক্ত হয়ে উঠেছে জীবজগতের কাছে। কারণ, জলের প্রবাহ না থাকায় লবণের মাত্রা পৌঁছেছে চরমে। যার ফলে, পুরোপুরি মুছে গেছে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রই। এমনকি এই জল পানের অযোগ্য অন্যান্য প্রাণীদের ক্ষেত্রেও।
আরও পড়ুন
রাতারাতি উজাড় সহস্রাধিক গাছ, আরাবল্লী-কাণ্ডে সরব পরিবেশকর্মীরা
শুধু বাস্তুতন্ত্রেই নয়, আঞ্চলিক মানুষদের জীবনেও বড়োসড় প্রভাব ফেলেছে এই বিপর্যয়। স্থানীয়দের মূল জীবিকা ছিল মৎস্য শিকার এবং কৃষিকাজ। মাছের অস্তিত্ব তো মুছে গেছে কবেই, বর্তমানে বন্ধ হতে চলেছে কৃষিকাজও। মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার কারণে প্রায়শই তৈরি হয় ভয়াবহ ধুলোঝড়। আর সেই ঝড়ের সঙ্গে কৃষিজমিতে ছড়িয়ে পড়ে সামুদ্রিক লবণ। ফলে, হারিয়ে যেতে বসেছে জমির উর্বরতাও। উপার্জনের জন্য এক প্রকার বাধ্য হয়েই তাই অন্যত্র আস্তানা নিয়েছেন অধিকাংশ বাসিন্দা। আর বিস্তীর্ণ অঞ্চলটা পরিণত হয়েছে সাক্ষাৎ ‘মৃত্যু উপত্যকায়’।
আরও পড়ুন
বদলে গেল পৃথিবীর মানচিত্র, সমুদ্র-তালিকায় নতুন সদস্য দক্ষিণ মহাসাগর
কিন্তু এত বড়ো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে যাওয়ার পরেও বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই গোটা বিশ্বের। ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে সম্পূর্ণ অবগত থেকেও কোনোরকম পদক্ষেপ নেয়নি রাশিয়াও। নদীর গতিপথ পুনরায় আরাল সাগরের দিকে ঘুরিয়ে দিলে যে ধাক্কা খাবে কটন ইন্ডাস্ট্রি! বরং, শুকিয়ে যাওয়ার আরাল সাগরের বুকে রীতিমতো তেল ও গ্যাস উত্তোলনের কাজে মন দিয়েছে রাশিয়ার একাধিক সংস্থা। আর উজবেকিস্থান সরকার? পরিবেশ বাঁচানো তাদের কাছে এখন বাতুলতাই বটে। ক্রমশ বাড়তে থাকে মরুভূমির প্রান্তবর্তী লোকালয়গুলিকে সুরক্ষিত করাই এখন তাঁদের প্রাথমিক লক্ষ্য। কিন্তু এভাবে আর কতদিন ঠেকিয়ে রাখা যাবে পরিস্থিতি? আর দু’দশকের মধ্যেই হয়তো সম্পূর্ণভাবে মুছে যাবে আরাল সাগর। তারপর? তারপর প্রকৃতির গ্রাসে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের সমগ্র মানব সভ্যতা! অথচ, তা নিয়ে ন্যূনতম চিন্তিত নয় প্রথম বিশ্বের উন্নত দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি…
আরও পড়ুন
বারবার ঘূর্ণিঝড়ে বিপর্যস্ত বাংলা, সমুদ্রের উষ্ণতা বৃদ্ধিই একমাত্র কারণ?
Powered by Froala Editor