দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। হিটলারের প্রবল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে অনেকেই। লড়াইয়ে প্রস্তুত ইংল্যান্ডও। কিন্তু হিটলার আর নাৎসিদের মুহুর্মুহু আক্রমণের সামনে কেউই দাঁড়াতে পারছে না। বিপর্যস্ত প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল। একটা সময় যখন সব উথাল পাথাল হয়ে যাচ্ছে, তখন পার্ল হারবার আক্রমণ করল জাপান। পরপরই হিটলার আর মুসোলিনিও আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। রাশিয়া তো আছেই, এবার ইংল্যান্ডের হাত ধরল শক্তিশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এবার সম্মুখ সমরে নামার পালা।
কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা এল কেন? কারণ, মাত্র দুটি দেশ— ইংল্যান্ড এবং আমেরিকা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একই পক্ষে থেকে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিল। একটু ইতিহাসের দিকে চোখ রাখলে দেখা যাবে, এই দুই ‘মিত্র’ই একটা সময় শত্রু ছিল পরস্পরের। আমেরিকা স্বাধীন হবার পর, ব্রিটিশদের আক্রমণও করেছিল। সালটা ১৭৭৮, দিনটা ২২ এপ্রিল।
শুধুমাত্র বাণিজ্যকে হাতিয়ার করে ব্রিটিশরা পৌঁছে গিয়েছিল বিশ্বের বহু জায়গায়। তারপর, বণিকের মানদণ্ডের রাজদণ্ডে পরিণত হতে সময় লাগেনি বেশি। ভারতবাসী তো সেই কথা ভালোভাবে জানে। আমেরিকাও এর অন্যথা নয়। আজকের প্রবল পরাক্রম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যে দেশ, সেও একটা সময় ব্রিটিশদেরই একটি উপনিবেশ ছিল। সেখান থেকেই আমেরিকার ভেতরে শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার চেতনা। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আমেরিকার একজনও প্রতিনিধি নেই। এছাড়াও অহরহ চলত অত্যাচার, নিয়মের বেড়াজাল। প্রতিবাদ তো শুরু হতই…
আমেরিকার স্বাধীনতার লড়াই ও সেই ইতিহাসের ব্যাপ্তি অনেক বিশাল। সেটা নিজেই পরিপূর্ণ একটি বিষয়। সেই প্রসঙ্গ এখন একটু পাশে থাক। ১৭৭৬ সাল, ৪ জুলাই— আমেরিকা তার প্রাপ্য স্বাধীনতা আদায় করে নিল। নিল তো বটে, কিন্তু এটাই কি আসল প্রতিশোধ হল? ইটের বদলে পাটকেল তো ছোঁড়া হল না। সেটাই বোধহয় ভেবেছিলেন জন পল জোন্স। আমেরিকার নৌবাহিনীর ইতিহাসে তাঁকে প্রধান পথিকৃৎ বলে মনে করা হয়। স্বাধীনতার যুদ্ধেও তিনি অংশ নিয়েছিলেন। যাই হোক, স্বাধীন হবার পরও তিনি প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আক্রমণের। শুধু দরকার ছিল সুযোগের।
সালটা ১৭৭৮, স্বাধীনতার বছর দুয়েক পরেই। ২২ এপ্রিলের রাতটি ছিল বড়ো মনোরম। ইংল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলের থেকে বেশ কিছুটা দূরে অন্ধকারে এসে ভিড়ল একটি জাহাজ। মামুলি জাহাজ নয়, আমেরিকান রেঞ্জার। যুদ্ধজাহাজ। সমস্ত বন্দুক পশ্চিম উপকূলের কাম্ব্রিয়ার দিকে ঘোরানো। দুটো বোট ওই জাহাজ থেকে এগিয়ে চলল সেই দিকে। ওই বোটেই আছেন জন পল জোন্স, সঙ্গে তাঁর লেফটেন্যান্ট ওয়ালিংফোর্ড-সহ আরও ২০-৩০ জন। পরিকল্পনাই ছিল দু-মুখো আক্রমণের। পশ্চিম সীমান্তেরই হোয়াইটহাভেন শহরের দুর্গ দখল করা, এবং প্রতিশোধ নেওয়া— এই ছিল লক্ষ্য।
কিন্তু পুরোপুরি সফল হয়নি এই হামলা। জাহাজ জ্বালানো হয়েছিল, বিনা রক্তপাতে হোয়াইটহাভেনের পুরনো দুর্গ দখলও হয়েছিল; কিন্তু সামগ্রিকভাবে এটিকে সফল বলা যায় না। বরং প্রতিশোধের একটা চেষ্টা বলা যায়। পরবর্তীতে জন পল জোন্স নিজেও তাই বলেছিলেন। ১৭৭৮-এর এই অভিযান নিয়ে পরে অনেক চর্চাও হয়। কিন্তু এইসবই ছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ। তবে বহুযুগ পর এককালের এই দুই প্রতিপক্ষই যে একসঙ্গে রণাঙ্গনে নামবে, সেটা কি ভেবেছিলেন তিনি!