বাংলার বুকে আবারও এক গর্বের শতবর্ষ। ইতিহাসের সারণি জুড়ে উঠে আসা লড়াই, প্রতিভা আর সর্বোপরি, ফুটবলের গল্প। আজকের এই দিনে গোটা ময়দানেরই রং হয়ে যায় লাল-হলুদ। বাঙালির চায়ের ভাঁড়ে তর্ক থাকবে, আর ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান থাকবে না, তা কি হয়! শতবর্ষের মশাল ঘাঁটলে বেরিয়ে পড়বে অনেক ছবি, অনেক ইতিহাস, স্মৃতি। উঠে আসবে সেই আইএফএ শিল্ড ফাইনালের কথা, যে ম্যাচে জিতে ট্রেবল বা ত্রিমুকুট জয়ের নজির গড়েছিল ইস্টবেঙ্গল। শুধু কি ইস্টবেঙ্গল? এই ম্যাচেরই অন্যতম নায়ক আপ্পারাওয়ের কাহিনি ক্রীড়াপ্রেমীদের রীতিমতো শিহরণ জাগাবে।
১৯৪৯-এর মরসুমে লীগ, রোভার্স কাপ ইতিমধ্যেই জিতে গেছে ইস্টবেঙ্গল। বাকি ছিল আইএফএ শিল্ড। সমস্ত ম্যাচ পেরিয়ে অবশেষে ফাইনালে পৌঁছে গেল টিম। ইতিহাস একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিপক্ষ মোহনবাগান। কাজেই উন্মাদনার পারদ ঠিক কোথায় চড়তে পারে তার ধারণা পাওয়াই যায়। এদিকে ইস্টবেঙ্গলের সামনে ইতিহাস গড়ার সোনার সুযোগ। তার ওপর টিম খেলছে সেই চিরাচরিত ২-৩-৫ ছকে। সামনে আমেদ, সালে, ধনরাজ, ভেঙ্কটেশ এবং আপ্পারাও। ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের কাছে এঁরা ‘পঞ্চপাণ্ডব’। এঁদের দৌড় তখন নাড়িয়ে দিচ্ছে বিপক্ষকে। কাজেই ইস্টবেঙ্গল দর্শকদেরও আশা…
গোলাপ বিছানো রাস্তায় সবটা সম্পন্ন হলে বীরের মাহাত্ম্য কোথায়? তবে সেই ঝড়টা এত মারাত্মকভাবে আসবে সেটা ভাবতেও পারেননি ইস্টবেঙ্গলের খেলোয়াড়রা। অন্যান্যদের মতো বেশ ভালো ফর্মে ছিলেন আপ্পারাও। প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। শিল্ড ফাইনালের কয়েক মুহূর্ত মাত্র বাকি। বলে রাখা ভালো, সতীর্থদের কাছে আপ্পারাওয়ের নাম ছিল ‘বাবা’। যাই হোক, ভোরবেলা উঠে একসঙ্গে ঘাবড়ে গেলেন ধনরাজ আর ভেঙ্কটেশ। ‘বাবা’কে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না! খেলার দেরি নেই; প্র্যাকটিসের কিছুক্ষণ বাকি, এখন গেল কোথায়? এদিকে কোচ জ্যোতিষ গুহকেও কিছু বলা যাবে না। একেই নানা চিন্তায় রয়েছেন; এমন খবর শুনলে কী না কী করে বসবেন। দুজনে বেরিয়ে খানিক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর হঠাৎ একটি পুলিশের গাড়ি দেখলেন। আর সেটা কিনা তাঁদেরই বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে!
খুন বা চুরি নয়; পুলিশের গাড়ি থেকে বেরোলেন আপ্পারাও। গুরুতর অবস্থা, শ্বাস নিতে পারছেন না। চোখ টকটকে লাল; দু’হাতে চেপে ধরে আছেন বুক। সেই অবস্থায় নিয়ে আসা হল ঘরে। কিছুক্ষণ থাকলেন ওইভাবে, আস্তে আস্তে কথাও ফিরে এল। কিন্তু খেলার মতো অবস্থা তো একদমই নয়। ভেঙ্কটেশ এবং ধনরাজ আলোচনা করতে লাগলেন কী করে গুহ স্যারকে বলা যায়? একে আইএফএ শিল্ড, তার ওপর প্রতিপক্ষ মোহনবাগান। আর কয়েক মুহূর্ত বাকি ম্যাচ শুরু হতে। পুরো কম্বিনেশনটাই তো ঘেঁটে যাবে! কিন্তু জানাতে তো হবেই! জ্যোতিষ গুহ এলেন, সঙ্গে ডাক্তারও। জ্যোতিষবাবুর মধ্যে তখন নানা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। একে মোহনবাগানের সঙ্গে শিল্ড ফাইনাল, তার ওপর ক্লাব কর্তাদের সঙ্গে বেশ অনেকদিনের মতবিরোধ চলছিল তাঁর। এই ম্যাচ তাঁর কাছে শেষ সম্বল। বাঁশি বাজার আর কয়েক ঘণ্টা বাকি, তার মধ্যে আপ্পারাওয়ের এই অবস্থা। এদিকে ডাক্তারের বিধান, এমন শরীরের অবস্থা নিয়ে খেললে হিতে বিপরীত হবে। তাহলে উপায়?
আর কিছু হোক আর না হোক, শেষ পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার নজির বাংলার খেলার জগতে আছে। ১৯১১-এর মোহনবাগানের শিল্ড জয়ের কথাই ভাবুন! বা সৌরভ গাঙ্গুলির ন্যাটওয়েস্ট জয়। ফরওয়ার্ড লাইনে আপ্পারাওকে ছাড়া ইস্টবেঙ্গল ভাবা যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত জ্যোতিষ গুহ ঠিক করেই ফেললেন, খেলা হবে। আপ্পা খেলবে। শচীনের সেই কথাটির মতো, ‘ম্যায় খেলেগা!’
ফাইনালে নামার আগে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নিলেন। শুশ্রূষা করলেন ডাক্তার। তিনি তখনও গুরুতর অসুস্থ। টিম লাইনআপে সত্যিই, নিজের পরিচিত ইনসাইডে নাকি অক্সিজেন নল লাগিয়ে নেমে পড়েছিলেন আপ্পারাও। অশক্ত শরীর, তবুও লড়ে যাবেন তিনি। লড়ে যাবেন জ্যোতিষ গুহ। আর তারপর? পঞ্চপাণ্ডবের কামাল সেদিন গোটা ময়দান দেখেছিল। ওইরকম ফরোয়ার্ড লাইন বাংলায় আর কটা উঠেছে বলা কঠিন। সবথেকে বড়ো কথা, নাকে নল নিয়ে, অসুস্থ শরীরে, আগুন ঝরিয়েছিলেন আপ্পারাও। সেখানে তিনি অন্য একজন মানুষ। কে বলবে, কয়েকঘণ্টা আগে তাঁর জীবন-মরণ সমস্যা হয়ে গিয়েছিল? সেদিন দুই গোলে মোহনবাগানকে হারিয়ে প্রথমবার ট্রেবল বা ত্রিমুকুট জয় করেছিল ক্লাবটি। সোনালি মুকুটে আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে সেই দিনটি।
আরও পড়ুন
ইস্টবেঙ্গল লিগ জেতায়, দুঃখে ‘দেশান্তরী’ হয়ে গিয়েছিলেন মোহনবাগানী লালাকাকু
ঋণ – রূপক সাহা, অর্পণ গুপ্ত
Powered by Froala Editor