বিগত দেড় বছরের বেশি সময় ধরে করোনা অতিমারীর কারণে থমকে গিয়েছে দেশের অর্থনীতি। বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কুটিরশিল্পীরা। বহু ঐতিহ্যশালী শিল্পই ধ্বংসের দিন গুনছিল। করোনা অতিমারী সেই সম্ভাবনাকে আরও উস্কে দিয়েছে। তবে ঠিক এরকম সময়েই দেশের কলমকারি শিল্পকে বাঁচাতে এগিয়ে এল একদল স্কুল পড়ুয়া। ভারতের কলমকারি শিল্পের পীঠস্থান অন্ধ্রপ্রদেশের মছিলিপত্তনম অঞ্চলের শিল্পীদের নিয়ে তারা গড়ে তুলেছে একটি নেটওয়ার্ক, কলমকারিকথা (Kalamkari)। এই অতিমারীর মধ্যেও শিল্পীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ থেকে শুরু করে গুদামবন্দি কাপড় বিক্রি করার একাধিক উদ্যোগ নিয়েছে তারা।
ভারতের অন্যতম ঐতিহ্যশালী কুটিরশিল্পগুলির একটি কলমকারি। আজও তার জনপ্রিয়তা নেহাত কম নয়। পৌরাণিক কাহিনি থেকে শুরু করে লোককথাকে কাপড়ের মধ্যে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলার এমন কাজ সত্যিই অবাক করে। আর তার চেয়েও বড়ো কথা, গোটা প্রক্রিয়ায় কোথাও যন্ত্র বা কৃত্রিম রঙের সাহায্য নেওয়া হয় না। পাথর ঘষে এবং গাছ-গাছরা থেকে রং তৈরি করে হাতে তৈরি ব্লকের সাহায্যে ছাপা হয় কাপড়। ২৩টি ধাপে ধীরে ধীরে রূপ পায় গোটা নকশা। কাজটি যেমন সময়সাপেক্ষ, তেমনই পরিশ্রমেরও। তবে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ছাপা সস্তার শাড়ির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছু হঠতে হচ্ছে এই শিল্পকে। অনেক শিল্পী এর মধ্যে কৃত্রিম রং বা যন্ত্রের ব্যবহারও শুরু করেছেন। তবে তাতে নকশার মূল বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠেনি। তাই অনেক শিল্পীই এখনও পুরনো রীতি আঁকড়ে রয়েছেন। করোনা অতিমারী এসে যেন কলমকারি শিল্পের কফিনে শেষ পেরেকটা পুঁতে দিয়ে গিয়েছিল। লকডাউনের পরে দেখা যায় মছিলিপত্তনম অঞ্চলের শিল্পীদের মোট ১২ লক্ষ টাকার কাপড় গুদামবন্দি হয়ে রয়েছে, অথচ বিক্রির কোনো উপায় নেই।
তবে লকডাউনের কিছুদিন আগেই গড়ে উঠেছিল কলমকারিকথা। স্কুল পড়ুয়াদের নিয়ে তৈরি এই উদ্যোগের নেপথ্যে রয়েছেন বাণিজ্যিক পরামর্শদাতা মানব সুবোধ এবং তাঁর সংস্থা ১এম১বি। বহুজাতিক সংস্থার চাকরি ছেড়ে ৭ বছর আগে দেশের কুটিরশিল্পগুলিকে বাঁচানোর লড়াই শুরু করেছিলেন সুবোধ। বলেছিলেন, অসংখ্য স্টার্ট-আপ সংস্থাকে পরামর্শ দিয়ে যদি লাভের মুখ দেখাতে পারেন তাহলে কুটিরশিল্পগুলিকেও লাভের মুখ দেখাতে পারবেন। আর দেশের ঐতিহ্যকে বাঁচাতে না পারলে সেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের কোনো মূল্যই নেই। তবে কেবল ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখলেই হবে না। তার সঙ্গে আগামী প্রজন্মের যোগসূত্রই তৈরি করতে হবে। আর এই উদ্দেশ্য থেকেই স্কুল পড়ুয়াদের নিয়ে কলমকারিকথার কাজ শুরু করেছিলেন তিনি।
কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র সহ দেশের বহু রাজ্যের পড়ুয়ারা এগিয়ে এসেছেন এই উদ্যোগে। তাদের উদ্যোগেই দেশের নানা প্রান্তে কলমকারি শিল্পের প্রদর্শনও হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। জাতিপুঞ্জের সঙ্গে মিলিতভাবে একটি আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে। আর পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমের সাহায্যে চলছে কলমকারি কাপড়ের হোম ডেলিভারির ব্যবসাও। কিছুদিনের মধ্যেই অনলাইন বিপণনের জন্য একটি ওয়েবসাইট তৈরির পরিকল্পনাও নিয়েছে পড়ুয়ারা। অর্থনীতির আধুনিক ব্যবস্থার সঙ্গে ঐতিহ্যকে মিলিয়ে দিয়ে এভাবেই কলমকারি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার স্বপ্ন বুনছে তারা। আর এই স্বপ্নের মধ্যে নতুন করে বেঁচে থাকার আশা খুঁজে পাচ্ছেন শিল্পীরাও।
আরও পড়ুন
জেলখানাকে শিল্পক্ষেত্রের রূপ দিতে এগিয়ে এলেন ব্যাংকসি
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
কালি ছাড়াই ত্বকের ওপর শিল্পকর্ম, ‘ডার্মাটোগ্রাফিয়া’-র রহস্য কী?