“এই পরিস্থিতিতে পরীক্ষা কীভাবে হবে, ফলাফল কীভাবে হবে— সেগুলো নিয়ে একটা বিরাট সংশয়ের মধ্যে দিয়ে আমরা সবাই যাচ্ছিলাম। অনেকেই এই আশঙ্কা প্রকাশ করছিলাম, ফলাফল নির্ধারনের পদ্ধতি যাই হোক না কেন শিক্ষার্থীরা যেন কোনো কটূক্তি বা বৈষম্যের মুখে না পড়ে। যেমন নকশাল আন্দোলনের পর বলতে শোনা যেত, ওমুকরা ওই সময়ের পাশ করা শিক্ষার্থী। যেন তাঁদের মেধার, তাঁদের শ্রমের কোনো মূল্যই আর নেই। পরিস্থিতিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে শিক্ষার্থীদের ওপর দায় চাপানোর ইতিহাস আমরা ইতিমধ্যেই বহন করি। বার বার তাদেরই হেয় করে দেখি। দেখা যাচ্ছে সেই শঙ্কা সত্যিই বাস্তবায়িত হতে শুরু হয়েছে। আমরা মাথাতেই রাখছি না, কী পরিস্থিতিতে এই মূল্যায়ন করতে হল।”
বলছিলেন মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রসঙ্গ, সদ্য-প্রকাশিত মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল। মঙ্গলবার ফল প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই, হাসি-ঠাট্টা, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের রোল ওঠে সোশ্যাল মিডিয়ায়। নেট দুনিয়ায় ভেসে ওঠে অজস্র মিম, ট্রোল। লক্ষ্য মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা। কেন না, পরীক্ষার পাশের হার ছুঁয়েছে ১০০ শতাংশ। কিন্তু মাধ্যমিক বা উচ্চ-মাধ্যমিক কোনো পরীক্ষাই যে হয়নি মহামারীর আবহে। আর এই ঘটনার জেরেই শিক্ষার্থীদের এমন ব্যঙ্গে বিঁধছেন নেটিজেনদের একাংশ। যার সামনে যেন লঘু হয়ে যাচ্ছে মহামারীর ভয়াবহ পরিস্থিতিটাই।
সেই কথাই ফুটে উঠল অনুত্তমার কথায়, “শিক্ষার্থীরা যে কী অবস্থার মধ্যে দিয়ে দিন কাটিয়েছে, আমরা ভাবছি না। তারা স্কুলে যেতে পারেনি, তাদের নিজস্ব জীবন, বন্ধুদের সঙ্গে কাটানো সময়, বিদ্যালয় থেকে রপ্ত করা আনুসাঙ্গিক এত দীর্ঘ সময় ব্যাহত হয়েছে। আমরা সেই অভিঘাতের কথা ভেবে দেখছি না। আমরা ভুলে যাচ্ছি যে আমরা এমন একটা দেশে বাস করি যেখানে অর্ধেক স্কুলের অনলাইন শিক্ষার পরিকাঠামোই নেই। ফলে সেখানে যথাযথ শিক্ষা পৌঁছে দিতে না পারার দায় পরীক্ষার ফলাফলের ওপর গিয়ে পড়লে সুবিচার হত কি? এই রকম একটা বিপজ্জনক দুর্যোগের পরিস্থিতিতে সত্যিই যাতে শিক্ষার্থীরা অবহেলিত না হয়, আনফেয়ার একটা ট্রিটমেন্টের মধ্যে গিয়ে না পড়ে— সেটা দেখাই তো আমাদের কর্তব্য হওয়ার কথা ছিল।”
অনেকের স্পষ্ট দাবি, দূরত্ববিধি ও অন্যান্য সতর্কতা মেনে করোনা পরিস্থিতিতেও পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারত। আর তেমনটা সম্ভব হলেই একমাত্র ‘প্রকৃত’ ফলাফল পাওয়া যেত বলে অভিমত তাঁদের। এহেন মন্তব্যের প্রেক্ষিতে অনুত্তমা যোগ করলেন, “হ্যাঁ, হতেই পারে অন্যভাবে পরীক্ষা হলে, যথাযথ মূল্যায়নের সুযোগ থাকলে হয়তো ফলাফল ভিন্ন হত। কিন্তু এমন অযথাযথ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আপামর বিশ্ব যাচ্ছে, সেখানে মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্ট যথাযথ মূল্যায়নের বহিঃপ্রকাশ হবেই এমনটা প্রত্যাশা করা যায় কি? আমরা শিক্ষার্থীদের মিম, ট্রোল ইত্যাদির মাধ্যমে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে এক অদ্ভুত বাস্তব-বিমুখতার ছবি তুলে ধরছি। ধরা যাক যদি মাধ্যমিক পরীক্ষা হত এবং দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রকোপের মধ্যে পড়ে অনেক শিক্ষার্থী সংক্রমিত হত তাহলে কি আমরা নিজেদের ক্ষমা করতে পারতাম? আজকে যখন দ্বিতীয় ওয়েভ কাটিয়ে উঠছি, আসন্ন তৃতীয় ওয়েভ নিয়ে উদ্বিগ্ন হচ্ছি সেখানে সংক্রমণের হার সামান্য কমেছে বলে, আমরা কি সত্যিই ভুলে যেতে পারি যে কোন অবস্থায় মাধ্যমিক পরীক্ষা হয়নি?”
পরীক্ষা না নেওয়ার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করলেও, অনেকে আবার প্রশ্ন তুলছেন ফলপ্রকাশের পদ্ধতি প্রসঙ্গে। সেখানে বার বার আলোচনায় উঠে আসছে ৭৯ জনের সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার ঘটনা। ফলপ্রকাশের পদ্ধতির পাশাপাশি ট্রোল করা হচ্ছে প্রথম সারির ছাত্রছাত্রীদের। একথা অস্বীকার করার জায়গা নেই যে, পরীক্ষা হলে হয়তো ফলাফল হুবহু এরকম না হলেও কাছাকাছি যেত অনেকটাই। কিন্তু নিজেদের মেধা বা যোগ্যতা প্রমাণ করার সুযোগটাও যে তারা পেল না, সেই বিষয়টিই এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে সম্পূর্ণভাবে। “এবারের মাধ্যমিক পরীক্ষার মূল্যায়ন অন্যভাবে করা যেত কিনা, বা দূরত্ববিধি মেনে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব ছিল কিনা— এ নিয়ে বিতর্ক আলোচনা চলতেই পারে। কিন্তু তাঁর মাশুল শিক্ষার্থীরা দেবে কেন? প্রক্রিয়াগত সিদ্ধান্তে তাদের কোনো হাত ছিল কি? শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই হয়তো চেয়েছিল সুষ্ঠু স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে পরীক্ষা দিতে, তার মেধার এবং শ্রমের যথাযথ মূল্যায়ন এবং পুরস্কার তারাও হয়তো আশা করেছিল। আমরা শুধু ভাবছি, তারা প্রচুর সুযোগ পেয়ে গেল। একবারও ভাবছি না, তারা কতটা বঞ্চিত হয়েছে গোটা বছর ধরে। যারা প্রথম হল, তাদের মেধার কোনো উদযাপনের স্থান আর রইল না। আমার মনে হয়, এখানে আমি পেলাম না, তুমি পেয়ে গেলে— এটা ভাবার আগে পরিস্থিতির সার্বিক যে বিপন্নতা ছিল, বিপর্যয় ছিল আমরা যদি সেটা না দেখি আবারও অতিসরলীকরণ করা হবে। ব্যঙ্গের এই অসংবেদনশীল ভাষার আমি প্রতিবাদ জানাই।”, জানালেন অনুত্তমা।
অসংবেদনশীলতা তো বটেই, এই ঘটনা যেন একপ্রকার প্রতিহিংসার বাতাবরণকেই উপস্থাপিত করছে বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে। এই আচরণ কি মর্ষকামেরই একটা বিবর্তিত রূপ? প্রশ্নের উত্তর দিলেন অনুত্তমা, “এখানে মর্ষকাম শব্দটিকে আমি মোটেই আনতে চাইব না। সেডিজমের মতো ভারি শব্দ এখানে আনার আমি সমর্থক নই। যে কোনো আক্রমণাত্মক আচরণের পিছনে সেক্সুয়াল প্লেজার থাকতেই হবে এমনটা আমি মনে করি না। সেডিজম শব্দটার সঙ্গে যেটা জড়িত। বরং এখানে সামাজিক প্রেক্ষাপটে অন্যকে বিদ্রুপ করার মধ্যে দিয়ে, অন্যকে ছোট করার মধ্যে দিয়ে নিজের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ এবং রসিকতার ভাষার মধ্যে অন্যকে হেয় করার একটা প্রবণতা, নানা প্রেক্ষিতে যেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি, এখানে আবার তার উদাহরণ উঠে এল। এই রসিকতা করতে গিয়ে তার মাত্রা কোথায় টানতে হবে তা ভুলে যাচ্ছি। কাকে নিয়ে রসিকতা করছি, কোন পরিস্থিতিতে করছি, কোন পরিস্থিতিতেই বা এমন রেজাল্ট বার করতে বাধ্য হতে হল - তার কোনোটাই যেন আমরা দেখছি না। আমরা একটা ব্যঙ্গের, বুলিং-এর ভাষা তৈরি করছি।”
তবে এই ব্যঙ্গস্রোতের মধ্যেও বিরূপ অবস্থান নিতে দেখা গেছে অনেককে। অনেকেই পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন শিক্ষার্থীদের। সরব হয়েছেন ট্রোলিং-এর এই বিকৃত মানসিকতার বিরুদ্ধে। সেইসঙ্গে প্রশংসিত হয়েছেন শিক্ষকরাও। তাঁরাও তো এই প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করে গেছেন সমানে। দ্রুত পাল্টে নিয়েছেন শিক্ষণের পদ্ধতি। তা কুর্নিশ করার মতোই। এই সংবেদনশীল মানসিকতাই তো কাম্য ছিল আমাদের গোটা সমাজের থেকে। সেই আদর্শ ও মূল্যবোধ সত্যিই কি ধরে রাখতে সক্ষম হলাম আমরা? প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে সেই জায়গাটাতেই…
Powered by Froala Editor