বিদেশি মুদ্রা থেকে বিরল ডাকটিকিট, সংগ্রাহকদের শেষ ঠিকানা বিবাদী বাগের বিমান কবিরাজ

বিবাদী বাগের কাছে, জেনারেল পোস্ট অফিসের ঠিক পেছনে সিঁড়ি বেয়ে ফিলাটেলিক ডিপার্টমেন্ট। ঘড়িতে দুপুর ১টা বেজে বাইশ মিনিট। দুপুরের মিঠে রোদ ধুয়ে দিচ্ছে সিঁড়ি। সিঁড়ির উপর বসে বেশ ক'জন। নানা সরকারি কাগজপত্রে দস্তখত, খামে ডাকটিকিট লাগাচ্ছেন কেউ কেউ। তবে সিঁড়ির ঠিক নিচেই ফুটপাথ জুড়ে দু'টো টেবিল। টেবিলের উপর একরাশ খাজানা! হ্যাঁ খাজানাই বটে। ডাকটিকিট আর মুদ্রা। তার কোনোটা হাঙ্গেরির, কোনোটা আইসল্যান্ডের, কোনোটা ইন্দোনেশিয়ার। সযত্নে প্ল্যাস্টিকের ছোট্ট ফোল্ডার মুড়ে, কাগজে পিন ভরে আটকানো। ডাকটিকিট আর কয়েনের আলব্যাম। সংগ্রহ সংক্রান্ত নানা বই। 

এক বৃদ্ধ বহুক্ষণ ঝুঁকে পড়ে মুদ্রা দেখছিলেন। খানিক বাদে ঈষৎ গলা খাঁকারি দিতেই টেবিলের উল্টোদিকের ভদ্রলোক উঁকি মারেন। বৃদ্ধের হাতে তুলে দিলেন দুটি মুদ্রা। ‘এই নিন স্যার, অর্ডার এসে গেছে।’ তারপর আমার দিকে চোখ তুললেন, ‘কী নেবেন?’ পরিচয় দিতে হয় নিজের। হাসলেন ভদ্রলোক। ‘ও! বাংলা পোর্টাল? বেশ বেশ। আমি বিমান কবিরাজ। আপনি তবে  আসল জায়গায় এসেছেন।’

কলকাতা শহরে মুদ্রা ও স্ট্যাম্পের খাসতালুক হাতে গোনা। কিছু পাওয়া যায়, পার্কস্ট্রিটের ‘হবি সেন্টারে’। তবে জাত-সংগ্রাহকদের মুখে শুনেছিলাম যে জেনারেল পোস্ট অফিসের সামনে একজন বসেন। তিনিই নাকি ‘অসলি সমঝদার।’ তাঁর সন্ধানেই মূলত শীতের দুপুরে পোস্ট অফিস অভিযান। 

নেতাজি নগরের বাসিন্দা বিমান কবিরাজ আগে কাজ করতেন জেনারেল পোস্ট অফিসেই। তবে তিনি ছিলেন ফিলাটেলি বিভাগের কর্মচারী। ছোট থেকে পুরনো মুদ্রা ও স্ট্যাম্পের উপর প্রবল আকর্ষণ। ফিলাটেলি বিভাগে থাকাকালীন নজরে পড়েন কিংবদন্তি স্ট্যাম্প সংগ্রাহক এবং ব্যবসায়ী পি.সি জয়সওয়ালের।

‘উনি না থাকলে আমি এই ব্যবসায় আসতে পারতাম না। সবটাই ওঁর হাতে শেখা।’ বলছিলেন বিমানবাবু।

আরও পড়ুন
পথের ধারে ছবির পসরা, নিজের শিল্পকে আঁকড়েই সংসার চলে গোলপার্কের 'ছবি-বুড়ো'র

জয়সওয়াল সাহেবের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছেন সারা ভারত। বিভিন্ন দুষ্প্রাপ্য কয়েনের এক্সিবিশনে অংশ নিয়েছেন তিনি। পরে ১৯৯৩ সালে গুরুর পরার্মশেই ব্যবসা শুরু করলেন তিনি। জিপিও-র পেছনেই দু'টি টেবিল নিয়ে বসে পড়লেন। তা অবশ্যই ফিলাটেলি বিভাগের অনুমতিতে। তারপর সকাল এগারোটা থেকে রাত্রি আটটা পর্যন্ত রোজের রুটিন। তবে কখনো কখনো বাড়িতেও ডেলিভারি দিয়ে থাকেন। কয়েন সংগ্রহ করেন বিভিন্ন সংগ্রহালয় থেকে। যেমন বেঙ্গালুরুর ‘ফ্যালকন গ্যালারি’। খদ্দেরের সংখ্যা বড়ো কম নয়। বরং নাকি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড থেকে প্রায়সই ডাক আসে। অনেক সময় গাড়ি থামিয়ে কোনো সাহেব সংগ্রহ করছেন কয়েন কিম্বা ‘ফার্স্ট ডে কভার’। ঐতিহাসিক ‘গিবনস ক্যাটালগ’, যাঁরা দেশবিদেশের ডাকটিকিট নিয়ে কাজ করেন, তাঁরাও নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন বিমানবাবুর সঙ্গে। পরামর্শ নেন। 

‘তবে কয়েন এবং ডাকটিকিটের জন্য যে ছেলেবেলার উন্মাদনা, তা ইন্টারনেটের সঙ্গে বোধহয় বেশ কিছুটা কমে গিয়েছে... কী বলেন?’

আরও পড়ুন
অসংখ্য দুষ্প্রাপ্য বইয়ের পসরা সাজিয়ে পাঠকের অপেক্ষায় গড়িয়াহাটের তাপস কয়াল

আমার খোঁচাটা বেমালুম হজম করে বিমানবাবু হাসলেন একমুখ।

‘বলেন কী! আমার দোকানে আপনাদের জেনারেশন কিংবা কচিকাঁচাদের ভিড়ই লেগে থাকে। এই লকডাউনের মধ্যে আমার ব্যবসা কিন্তু এক্কেবারেই মার খায়নি। উল্টে বাড়ি বাড়ি ডাক মারফৎ কয়েন আর ডাকটিকিট পাঠিয়েছি। বাচ্চারা আজকাল বেশি কেনে। প্রবীণ সংগ্রাহকরাও আছেন। তাঁদের মধ্যে থানার অফিসার থেকে রাজ্যপাল…’

আরও পড়ুন
শীতপোশাকের পসরা, ডিসেম্বরের কলকাতা ও একটি 'পাহাড়িয়া' ফুটপাতের গল্প

‘রাজ্যপাল?...’ বিস্ময়ে কথা সরে না আমার।

‘হ্যাঁ… গোপালকৃষ্ণ গান্ধী। উনি কোথাও হয়তো শুনেছিলেন, উত্তম কুমারকে নিয়ে একটি বিরল ‘ফার্স্ট ডে কভার’ আমার কাছে রয়েছে। তৎক্ষণাৎ আমায় ডেকে পাঠালেন ‘উত্তম মঞ্চে’। তাঁর উৎসাহ দেখে অবাক হয়ে যাই আমি। এতবড়ো মাপের একজন মানুষের ডাকটিকিট পেয়ে সেকি শিশুসুলভ খুশি! তারপর নিজে হাতে, ন্যায্য দামে কিনলেন সেই ডাকটিকিট। সেই দিনটা আজও মনে পড়ে…’

গায়ে কাঁটা দিল। আসল জায়গায় এসে পড়েছি তাহলে….

তবে বিমানবাবুর মতো একজন ‘জহুরী’র কী ইচ্ছা হয় না, দু-একটি দুষ্প্রাপ্য মুদ্রা নিজের সংগ্রহে রাখার? 

‘নাঃ, আসলে এত দেখে ফেলেছি যে আমার আর লোভ চলে গেছে। দেখুন, আমি সবার আগে ব্যবসায়ী। মোগল আমল থেকে হালের কুড়ি-টাকার কয়েন পর্যন্ত হাত-বদল হয়। ডাকটিকিটের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই। আমি আমার এই দুনিয়াটাকে খুব ভালোবাসি। ভালোলাগে সংগ্রাহকদের পাগলামিটা। এই তো দেখুন, একটু আগেই যিনি এসেছিলেন তিনি থাকেন সেই টাকিতে। বয়স্ক মানুষ। অন্যসময় আমি ‘বাই-পোস্ট' পাঠাই। আজ নিজেই চলে এলেন…’

বিকেলের নরম আলো পড়ছিল টেবিলের ওপর। ঝলসায় ‘সাত রাজার ধন।' আমার মনটাও কেমন অদ্ভুত খুশিতে ভরে যায়…

যাক, এই কঠিন সময়েও কিছু পাগলামি বেঁচে আছে...

কৃতজ্ঞতা স্বীকার : বিমান কবিরাজ

Powered by Froala Editor